সশস্ত্র বাহিনীর সামর্থ্য বাড়ানোর প্রস্তাব
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সামর্থ্য ও সক্ষমতা বাড়াতে নতুন পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর। দুই দিনের ঢাকা সফরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় তিনি এ প্রস্তাব দেন। দুই নিকট প্রতিবেশীর সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা জোরদারের লক্ষ্যে এ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার তাঁর দুই দিনের সফর শেষে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে। মনোহর পারিকর এদিন সন্ধ্যায় ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে ঢাকা ছেড়ে গেছেন।
এদিকে বাসস জানায়, ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, কোনো দেশের বিরুদ্ধেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। গতকাল গণভবনে ওই আলোচনার পর প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে মনোহর পারিকরের ব্যাপকভিত্তিক আলোচনায় দুই দেশের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে বিদ্যমান ঘনিষ্ঠ ও ভ্রাতৃপ্রতিম বন্ধন আরও জোরদার হয়েছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সামর্থ্য ও সক্ষমতা বাড়াতে নতুন কিছু উদ্যোগ নেওয়ার প্রস্তাব করেছেন। তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রদর্শিত স্বয়ম্ভরতা অর্জনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রূপকল্প (ভিশন) বাস্তবায়নে ভারতের পূর্ণ সমর্থনের কথা জানান। এসব আলোচনায় প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বাড়ানো, যৌথ মহড়া পরিচালনা, এইচএডিআর (মানবিক সহায়তা ও দুর্যোগ মোকাবিলা) কর্মসূচি বাড়ানোর অনুষ্ঠান ও সামুদ্রিক অর্থনীতিতে সহযোগিতার প্রসঙ্গ উঠে আসে।
ভারতের কোনো প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে মনোহর পারিকরই প্রথম বাংলাদেশে এলেন। সম্প্রতি নিষ্পত্তি হওয়া স্থল ও সমুদ্রসীমার পর অনুষ্ঠিত এ সফরে দুই দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর মধ্যে বিনিময় বেড়েছে। এটি কোনো প্রতিবেশী দেশে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর প্রথম সফর এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকারের বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের গুরুত্বের ইঙ্গিতবাহী।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর বাংলাদেশে আসার আগে সে দেশের গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, ডিসেম্বরে দিল্লিতে শেখ হাসিনা-নরেন্দ্র মোদি শীর্ষ বৈঠকে একটি নিরাপত্তা সহযোগিতা চুক্তি সইয়ের জন্য চূড়ান্ত করাই পারিকরের সফরের মূল লক্ষ্য। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে এ খবর প্রচার করা হয়েছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই দেশের সামরিক সহযোগিতা জোরদারের জন্য নতুন এক রূপরেখার প্রস্তাব দিয়েছে ভারত। এই রূপরেখায় প্রশিক্ষণ, যৌথ মহড়াসহ বিভিন্ন উপাদান রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন গত রাতে বলেন, ‘ভারত এই অঞ্চল ছাড়িয়ে তার কৌশলগত অবস্থান জোরদারের পদক্ষেপ নিয়েছে। আর ভৌগোলিক কারণে ভারতের কৌশলগত এই অবস্থানের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। বর্তমান সরকার আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সক্ষমতা আরও বাড়ানোতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। ভারতের সঙ্গে নতুন কী ধরনের সহযোগিতা হতে যাচ্ছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। সেটি স্পষ্ট হলে এ নিয়ে মন্তব্য করা সহজ হবে।’
মনোহর পারিকরের সফরের আগে ভারতের আইবিটাইমস-এর এক খবরে বলা হয়, ভারত তার বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে প্রতিরক্ষাজনিত প্রয়োজনে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত, তা পারিকরের বাংলাদেশ সফর থেকে স্পষ্ট। ভারতের গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের গবেষক অধ্যাপক ভরত কনরাড আইবিটাইমসকে বলেন, এই অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান অগ্রযাত্রা প্রতিহত করতে চায় ভারত। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের যে সাবমেরিন চুক্তি হয়েছে, তা থেকে বেইজিং হয়তো সুবিধা আদায় করতে চাইবে। কিন্তু মোদির সরকার তা হতে দেবে না। আইবিটাইমস-এর ওই খবরে আরও বলা হয়, ভারত সম্ভবত বাংলাদেশকে উপকূলীয় অঞ্চলে টহল জাহাজ দেওয়ার প্রস্তাব করবে, যা এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশে ভারত এরই মধ্যে রপ্তানি করতে শুরু করেছে। পারিকর তাঁর সফরের সময় হয়তো ঢাকার সঙ্গে দুই দেশের নিয়মিত যৌথ সামরিক মহড়ার ব্যাপারেও কথা বলবেন। এ ছাড়া দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা খাতে নতুন মাত্রায় সহযোগিতার ব্যাপারেও কথা বলবেন পারিকর ও তাঁর সঙ্গে সফরকারী প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা। এই পদক্ষেপের আওতায় বাংলাদেশকে সামরিক সরঞ্জাম, প্রযুক্তি সরবরাহসহ যৌথ মহড়া এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে ভারত।
বাংলাদেশ কেন চীনা সাবমেরিন নিজের বহরে সংযুক্ত করতে যাচ্ছে তা ভারতের প্রতিরক্ষাবিষয়ক বিশ্লেষকেরা বুঝতে পারছেন না। সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরোধের মীমাংসা এর মধ্যেই হয়ে গেছে। তা ছাড়া সাবমেরিন সব সময় আক্রমণাত্মক সমরাস্ত্র হিসেবেই বিবেচিত হয়, বিশেষ করে সমুদ্রসীমায় বিরোধ থাকলে।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা: মনোহর পারিকরের সঙ্গে আলোচনার শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল অবদানের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। তিনি তাঁর আসন্ন ভারত সফরের সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর বীর সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোরও আগ্রহ প্রকাশ করেন। জবাবে মনোহর পারিকর বলেন, ‘প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সহযোগিতা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব ছিল এবং আমরা সেই সহযোগিতাটাই করেছি।’
সম্প্রতি বাংলাদেশি জেলেদের উদ্ধার করে কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করায় ভারতের কোস্টগার্ডকে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী। এ সময় ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বাংলাদেশের কোস্টগার্ডের দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন। পারিকর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের, বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়নের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, ‘বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়নে প্রভূত উন্নতি করেছে, যা ভারত এখনো করতে পারেনি।’
বৈঠকের শেষ অংশে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে অংশ নেওয়া ভারতীয় হেলিকপ্টারের একটি রেপ্লিকা এবং যুদ্ধকালীন ছত্রীসেনাদের অপারেশন পরিচালনার আলোকচিত্র প্রধানমন্ত্রীকে উপহার দেন। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাহফুজুর রহমান এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা উপস্থিত ছিলেন।
শিখা অনির্বাণে ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পুষ্পস্তবক অর্পণ: ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী গতকাল ঢাকা সেনানিবাসের শিখা অনির্বাণে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ হওয়া সশস্ত্র বাহিনীর বীর সদস্যদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে সেনাকুঞ্জে সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল তাঁকে গার্ড অব অনার দেয়। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. মাহফুজুর রহমান এ সময় উপস্থিত ছিলেন। পরে ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী তাঁর সফরসঙ্গীদের নিয়ে চট্টগ্রামের ভাটিয়ারীতে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি পরিদর্শন করেন।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের এক প্রতিনিধিদল দুদিনের সফরে গত বুধবার বাংলাদেশে আসে।