সুযোগ আসছে কাজে লাগাতে পারবে কি বাংলাদেশ ?
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: বহুজাতিক ব্যাংক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক (এসসিবি) ঢাকায় নিয়মিতভাবে ‘চায়না নাইট’ বা চীন-রজনীর আয়োজন করছে। ব্যাংকটির মূল দপ্তরে চালু করা হয়েছে বিশেষ চীন ডেস্ক। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনা গ্রাহকদের যোগাযোগ সহজ করতে চীনাভাষী রিলেশনশিপ ম্যানেজার আছেন সেখানে। ব্যাংকটি চীনা ভাষায় বইও প্রকাশ করেছে। নতুন যেসব চীনা কোম্পানি বাংলাদেশের বাজারে আসবে, বইটি হবে তাদের গাইড। চীনের সিল্ক রোড প্রকল্পের অধীনে বাংলাদেশে সম্ভাব্য চীনা বিনিয়োগ থেকে ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হওয়াই এসবের উদ্দেশ্য। ইতিমধ্যে এসসিবি জ্বালানী-বিদ্যুৎ ও অবকাঠামো খাতে চীনা বিনিয়োগের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। টেলিকম খাতেও চীনের এক্সিম ব্যাংকের বিনিয়োগসঙ্গী ছিল এসসিবি। বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পে জড়িত হতে প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশে কর্মরত আরো কয়েকটি ব্যাংক।
অথচ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিংবা পরিকল্পনা কমিশনে নেই কোনো বিশেষ চীন ডেস্ক। এখন পর্যন্ত এ প্রকল্প বিষয়ে পাওয়া যায়নি সামগ্রিক নীতিগত দলিল। অথচ চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার। মূল-চীন বলে পরিচিত গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এবং হংকং ও তাইওয়ানই বাংলাদেশের সরাসরি বিনিয়োগকারী (এফডিআই) বড় দেশ। ২০১৫ সালে এর পরিমাণ ছিল ১৯৩ মিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ও চীন ইতিমধ্যে আমব্রেলা চুক্তির অধীনে বিনিয়োগ শক্তিশালী এবং উৎপাদনক্ষমতা বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছে। অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে অবকাঠামো, জ্বালানি ও শক্তি, যোগাযোগ ও পরিবহন এবং চট্টগ্রামে চীনা অর্থনৈতিক ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল অঞ্চল (ইপিজেড) প্রতিষ্ঠাসহ ২৫টি প্রকল্প। এসবে মোট বিনিয়োগ করা হবে ২৪ বিলিয়ন ডলার। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক বাংলাদেশের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও হেড অব গ্লোবাল ব্যাংকিং নাসের এজাজ বিজয় বলেন, ‘চট্টগ্রাম ও মোংলার দুটি সমুদ্রবন্দরের আধুনিকীকরণ ও সামর্থ্য বাড়ানো এবং পায়রা ও সোনাদিয়ায় প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্রবন্দর অর্থনীতিতে বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলবে। রাজস্ব যেমন বাড়বে, তেমনি বাংলাদেশের অনুকূলে বাণিজ্যিক ভারসাম্যও বাড়াবে। এসব বন্দর ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক সমুদ্র পরিবহনের সঙ্গে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের বর্ধনশীল সামুদ্রিক বাণিজ্যকে তাল মেলাতে সাহায্য করবে। চীনের জন্য বিশেষ রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলে (ইপিজেড) ৭৫ হাজার থেকে এক লাখ বাংলাদেশির সরাসরি কর্মসংস্থান হবে। এই ইপিজেডে ১৫০ থেকে ২০০টি শিল্প ইউনিটে জাহাজ নির্মাণ, ওষুধ, ইলেকট্রনিক, কৃষিভিত্তিক, তথ্যপ্রযুক্তি, শক্তি ও টেক্সটাইল ও টেক্সটাইল যন্ত্রাংশ তৈরি করা হবে। এভাবে ভূরাজনৈতিক সুবিধা ব্যবহার করে আমরা ভারত মহাসাগরের আঞ্চলিক প্রবেশমুখের সুবিধা পাব।’
বাংলাদেশের আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের ১৫.৯ শতাংশের অংশীদার চীন। মূলত রপ্তানি হয় পোশাক (৮৪ ভাগ), চামড়া, পাট (পাট ও পাটজাত পণ্য) ও হিমায়িত খাদ্য। বিআরআইয়ের মাধ্যমে চীন-মিয়ানমারের সঙ্গে কানেকটিভিটি বা সংযোগ নিবিড় হলে বাণিজ্যের আওতাও অনেক বাড়বে। বর্তমানে ৪ হাজার ৭০০ বাংলাদেশি পণ্য চীনের শুল্কসুবিধা পায়। চামড়াজাত পণ্য ও তামাকসহ আরও ১৭টি পণ্যও যোগ হবে এই তালিকায়। বিআরআই প্রধান প্রধান বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুযোগ আরো বাড়াবে বলে মনে করা হচ্ছে। গত কয়েক বছর যাবৎ চীনের কাছ থেকে পোশাকশিল্প পণ্যের জন্য এই সুবিধা বাংলাদেশ চেয়ে আসছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বিপুল বাণিজ্যঘাটতি কি তাতে কমবে? যেখানে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানির হয় ৬৬৩.৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য, সেখানে আমদানি হয় ৯.৬৬২.৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলওয়ার হোসেন মনে করেন, ‘বাজার অর্থনীতিতে আমদানিও গুরুত্বপূর্ণ। চীন থেকে যা আমদানি করছি, তা আমাদের শিল্পায়নকে এগিয়ে দিচ্ছে। জাপান, কোরিয়া বা জার্মানি থেকে আমদানি করা তো আরও ব্যয়বহুল।’
চীনের অর্থনীতির রূপান্তর থেকে বাংলাদেশের সুবিধা নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘চীনে হোয়াইট কলার শ্রমিক কমে যাচ্ছে, শ্রমঘন শিল্প থেকে তারা সরে আসছে, গার্মেন্টস কারখানা কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে তাদের মধ্যবিত্তের আয়তন বড় হচ্ছে। চীনের ছেড়ে দেওয়া এসব শিল্প যদি বাংলাদেশে আনা যায় এবং চীনারা যদি এসবে বিনিয়োগ করে, তাহলে বহির্বিশ্বে এসব পণ্যের বাজারটাও আমরা পেতে পারি। তাদের নিজস্ব বাজারের জন্যও তারা আমাদের দেশে বিনিয়োগ করতে পারে।’
ঢাকা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আবুল কাশেম খান মনে করেন, বাংলাদেশের দুই পাশে দুই বৃহৎ অর্থনীতির উত্থান থেকে সুবিধা নিতে আঞ্চলিক কানেকটিভিটি বাড়ানো দরকার। তাঁর ভাষায়, ‘বাংলাদেশ চীন-ভারতের মধ্যে পণ্য সরবরাহ এবং উৎপাদন তথা ম্যানুফ্যাকচারিং কেন্দ্রভূমি হয়ে উঠতে পারে। চীনা প্রেসিডেন্টের সফরের সময় যে ২৪ বিলিয়ন ডলারের অঙ্গীকার করা হয়েছে, সেটাই তো বাংলাদেশে বিআরআইয়ের দিকনির্দেশনা। কিন্তু তার জন্য বিবিআইএম, বিসিআইএম, বিমসটেক ও সার্কের মতো আঞ্চলিক যোগাযোগ কাঠামোকে সক্রিয় করা দরকার।’
তিনি মনে করেন, ‘আমরা আইটি থেকে শুরু করে ভারী শিল্প, ইলেকট্রনিক ও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পদ্রব্য থেকে শুরু করে শ্রমঘন শিল্পগুলো বাংলাদেশে টানতে পারি। কিন্তু বাস্তবায়নটা দ্রুততর করা দরকার। জ্বালানি গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং সড়ক ও বন্দরের কানেকটিভিটি দ্রুত সম্পন্ন না হলে সুযোগ হাতছাড়া হতে পারে।’ বাণিজ্যঘাটতি বিষয়ে এই শিল্পোদ্যোক্তা মনে করেন, ‘অল্প সময়ে বাণিজ্যঘাটতি কমবে না। এর জন্য আমাদের দক্ষতা, প্রযুক্তি ও পরিকল্পনাগত অনেক উন্নতির দরকার আছে।’
চীনে নিযুক্ত সাবেক বাংলাদেশি কূটনীতিবিদ আশফাকুর রহমান মনে করেন, ‘সিঙ্গাপুরের সমৃদ্ধি দাঁড়িয়ে আছে দুটি জিনিসের ওপর: বিমানবন্দর আর সমুদ্রবন্দর। বিআরআই থেকে সুফল নিতে হলে আঞ্চলিক যোগাযোগ ও মুক্তবাজারের উদারতা দেখাতে হবে।’
বাণিজ্যিক উদারতা থেকে সব দেশ লাভবান হয়নি বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তীতুমীর। তিনি বলেন, ‘উদারতাবাদ ও মুক্তবাজারই যদি উন্নতির সোপান হতো, তাহলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য বাড়েনি কেন? আমাদের বাণিজ্য চীনের সঙ্গে, ইউরোপের সঙ্গে, আমেরিকার সঙ্গে; কিন্তু নিজেদের মধ্যে নয়। নতুন বাজার সৃষ্টি হলেও উন্নয়নশীল দেশের নিজস্ব পুঁজি সৃষ্টি হয়নি। বিদেশি ব্যবসায়ীদের মুনাফার একটি অংশ স্থানীয় পুঁজি হিসেবে বিনিয়োজিত হয়নি। পশ্চিমা বিশ্বায়নের সুফলও পেয়েছে গুটিকয় দেশের সীমিত একটি অংশ। অন্যদিকে উন্নত ও অনুন্নত উভয় দেশেই বৈষম্য বেড়েছে। প্রতিক্রিয়ায় ডোনাল্ড ট্রাম্প কিংবা ব্রেক্সিটের মতো অনুদার নীতি জনপ্রিয় হচ্ছে। আমরা বিকৃত বিশ্বায়ন চাই না। এ অবস্থায় চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ নতুন ধরনের বহুত্ববাদ বা মাল্টিল্যাটারিলজমের ইঙ্গিত দিচ্ছে। আমরা সত্যিকার উদারতার পক্ষে, যেখানে উৎপাদনের উপকরণ, পুঁজি ও প্রযুক্তির সুষম চলাচল ঘটবে।’
অর্থনীতিবিদ তিতুমীর বলেন, ‘আমাদের ঠিক করতে হবে, আমরা কি আমদানি ব্যবসা করব নাকি উৎপাদন বাড়িয়ে দেশে ও বিদেশে বাজার তৈরি করব? এমন শিল্পনীতি নিতে হবে, যা দেশে ভোগ ও বিদেশে রপ্তানি বাড়াবে। আমাদের বাণিজ্যিক যোগাযোগজালকে উৎপাদনমুখী যোগাযোগজালে পরিণত করতে হবে। চীনের ছেড়ে দেওয়া কারখানা ও পুঁজি আমাদের এখানে পুনঃস্থাপন ও পুনঃ বিনিয়োগের রূপরেখাটা কী হবে? পরিকল্পনা কমিশন, ইআরডি, অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিলিয়ে সমন্বিতভাবে চিন্তা ও কাজ করতে হবে।’
উন্নয়নকে টেকসই ও সবার জন্য করার জন্য দরকারি ও উপযুক্ত শর্তের ওপর জোর দেন তীতুমীর। তিনি বলেন, ‘স্থানীয় শ্রম, পুঁজি ও প্রযুক্তিকে গতিশীল করতে হবে। ভারত ২ বিলিয়ন ডলার বা চীন ২৪ বিলিয়ন ডলারের যে ঋণ দিচ্ছে, একে টেকসই ঋণ ব্যবস্থাপনা বলা যায় না। একসময় এসব ঋণ শোধ করা কঠিন হয়, তখন আরও ঋণ নিতে হয়। এ ধরনের ঋণ-অর্থায়নের কারণেই গ্রিস ও ইতালি বিরাট সমস্যায় পড়েছিল। বর্তমানে ঋণের সুদ-আসল ফেরত দিতেই বাজেটের বড় অংশ চলে যাচ্ছে। এমন বিদেশি বিনিয়োগ হতে হবে, যেখানে লাভ-লোকসান দুটিই ভাগ হবে। একে বলা হয়, ঝুঁকি-বণ্টনমূলক অর্থায়ন কাঠামো। আমরা চাইব, কানেকটিভিটি ও বিনিয়োগ দেশীয় পুঁজি গঠনে ভূমিকা রাখবে।’
চীনের উদ্যোগে নয়া বিশ্বায়নকে তাই সৃজনশীলভাবে ধারণ করার কথা বলেন অর্থনীতিবিদ তীতুমীর। ‘শুধু খণ্ড খণ্ড প্রকল্প জোড়া লাগানো আর বিরাট আকারে ঋণ-তহবিল গঠন করলেই উন্নয়ন হয় না, চিন্তাকাঠামো এবং কাজের ধারাই বদলে ফেলা দরকার। তা না হলে বর্তমানের কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধির বর্তমান মডেল নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে’, বলেন তিনি।
বিআরআই প্রকল্পে লাভবান হওয়ায় বাংলাদেশের সক্ষমতা বিষয়ে কোনো কোনো বিশ্লেষক প্রশ্ন তুলছেন। দক্ষতাঘাটতি পূরণে বিদেশি কর্মী আনতে হচ্ছে অনেক খাতেই। তাতে করে রেমিটেন্সপুষ্ট বাংলাদেশ হয়ে পড়েছে রেমিটেন্স পাঠানোর দেশে। স্থানীয় শ্রমদক্ষতা বাড়ানোর দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। বিদেশি ঋণ ও বিনিয়োগের মধ্যে ভারসাম্য আনাও জরুরি। চীনের বিআরআই শুধু রাষ্ট্রীয় বিষয় নয়। সরকার বদলালেও বন্ধুত্ব অক্ষুণ্ন রাখার কাঠামোটা কী হবে? যুক্তরাষ্ট্র-জাপান, যুক্তরাষ্ট্র-কোরিয়া কিংবা চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক জনগণের স্তরেও আস্থা সৃষ্টির মাধ্যমে প্রসারিত হয়েছে। সুযোগ দেওয়ার বিষয় নয়, নেওয়ার বিষয়। তার জন্য সামর্থ্য ও যোগ্যতা বাড়ানোর দায়টা বাইরের কারোর নয়, বাংলাদেশেরই।