ব্যাংকিং খাতে অর্থমন্ত্রীর পাপ কর !

নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: আমরা সবাই যে এতটা পাপে ডুবে আছি, তা স্মরণ করিয়ে দেওয়ায় অর্থমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। বছর কয়েক আগে চালু করা ‘পাপ কর’ (Sin Tax)-এর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু এবারের বাজেটে ‘পাপ কর’-এর হারটা বাড়িয়ে দিয়ে তিনি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে আমরা যেহেতু ‘পাপ করে’ই চলেছি, সেহেতু আমাদের ‘পাপ কর’-এর হার বাড়বে। ব্যাংক লুটের নতুন নতুন রেকর্ডের পরও যেহেতু আমরা ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিইনি, সেহেতু পাপ লাঘবের জন্য আমানতকারীদের ওপর করের বোঝা বাড়ানোর মতো একটি কল্যাণকর ব্যবস্থা না নিয়ে অর্থমন্ত্রী থাকেন কী করে? সুতরাং, তিনি আমানতের ওপর নতুন বর্ধিত হারে আবগারি শুল্কের প্রস্তাব করেছেন।

জেলা শহরে গাঁজা, আফিম ও দেশীয় মদের মতো নেশাদ্রব্য বিক্রির জন্য সরকারের বিশেষ অনুমতিপ্রাপ্ত যে দু-একটি দোকান আছে, সেগুলো আবগারি দোকান হিসেবে পরিচিত। অর্থশাস্ত্রের পরিভাষায়, আবগারি শুল্ক হচ্ছে ‘পাপ কর’। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় অর্থনৈতিক পত্রিকা দ্য ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস-এর অনলাইন লেক্সিকনে আবগারি শুল্ক বা এক্সাইজ ট্যাক্সের সংজ্ঞায় বলা হচ্ছে, আবগারি শুল্ক নির্দিষ্ট কিছু পণ্য (দেশে উৎপাদিত), যেমন তামাক, অ্যালকোহল এবং জ্বালানি তেলের ওপর আরোপ করা হয়। এই শুল্ক বা তথাকথিত ‘পাপ কর’-এর হার নিয়মিত ভিত্তিতে পর্যালোচনা করা হয়ে থাকে।

অন্যান্য অভিধানে বলা হচ্ছে, দেশের ভেতরে উৎপাদিত পণ্য ও সেবার ওপর আবগারি কর আরোপ করা হয়ে থাকে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেশীয় পণ্য এবং সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর বা ভিএটি প্রথা চালু হওয়ার পর আবগারি শুল্ক শুধু ক্ষতিকর সামগ্রীর (নেশাদ্রব্য অথবা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর জ্বালানি তেল) ওপর আরোপিত হয়। সমাজের ক্ষতি করে এমন সব দ্রব্য ভোগ করা থেকে মানুষকে নিবৃত্ত করা, নিদেনপক্ষে নিরুৎসাহিত করাই হচ্ছে এই আবগারি করের উদ্দেশ্য। আর সে জন্য এর খ্যাতি হচ্ছে ‘পাপ কর’ হিসেবে। যাঁরা বিড়ি-সিগারেট কিংবা জর্দা-তামাকের প্যাকেট বা কৌটা দেখেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন যে আবগারি পরিশোধের প্রমাণ হিসেবে ওসব পণ্যে আলাদা স্ট্যাম্প অথবা ব্যান্ডরোল ব্যবহৃত হয়। এই ‘পাপ কর’-এর কোনো তকমা যে ব্যাংকিং খাতের গ্রাহকদের বহন করতে হচ্ছে না, সেটা হয়তো অনেকের জন্য স্বস্তির বিষয় হতে পারে।

ইংল্যান্ডের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, সেখানে ব্যাংক আমানতের ওপর কোনো ধরনের আবগারি শুল্ক নেই। সুদের ওপর যে কর আছে, তা আয়কর। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও সুইজারল্যান্ডেও খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হলাম, ওসব দেশের কোথাও ব্যাংক আমানতের ওপর আবগারি কর নেই। ভারতে ব্যাংক আমানতের ওপর সুদ হিসেবে বছরে যদি ১০ হাজার রুপি আয় হয়, তবেই তার ওপর কর প্রযোজ্য হয়। যুক্তরাষ্ট্রে আয় হওয়া সুদের ওপর আয়কর আছে, আমানতের ওপর কোনো কর নেই। আমাদের অর্থমন্ত্রী রাজস্ব আদায় বাড়ানোর জন্য যে সৃজনশীলতা প্রয়োগ করে ব্যাংক আমানতের ওপর আবগারি কর আরোপ করেছেন, সেই ধারণাটি কোত্থেকে এল, সেটাই একটি বড় প্রশ্ন। পৃথিবীর আর কোনো দেশে ব্যাংকে আমানত রাখাকে পাপ হিসেবে গণ্য করা হয় কিংবা জনগোষ্ঠীকে ব্যাংকবিমুখ করতে কর আরোপ করা হয়, তা আমাদের জানা নেই। সরকার তা জানালে সেই দেশের অভিজ্ঞতাটি ঝালিয়ে নেওয়া যেত।

এই আবগারি কর আদায়ের বিষয়টি আমানতকারীর জন্য একটি ক্রমাগত নিপীড়নের বিষয়ে পরিণত হওয়ার আশঙ্কাটি আরও গুরুতর। বাংলাদেশে আমরা যাঁরা ব্যাংকের সেবা গ্রহণ করি, তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠই সঞ্চয়ী হিসাব (সেভিংস অ্যাকাউন্ট) ব্যবহার করেন। বাণিজ্যিক কাজে ছাড়া চলতি হিসাব (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট) ব্যবহারের চল খুব একটা নেই। এখন একজন গ্রাহকের সঞ্চয়ী হিসাবে সঞ্চয় ছাড়াও নিয়মিত লেনদেনে টাকা জমা হতে পারে, যেমন তাঁর মাসিক বেতন। যখনই তাঁর বেতন জমা হবে তখনই হিসাবে সঞ্চিতি বাড়বে, কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই তা আবার একেবারে তলানিতে নেমে আসতে পারে। এখন বছরে তাহলে অন্তত ১২ বার আবগারি শুল্কের স্তরে পড়বে। কিন্তু তাঁর হিসাব থেকে এই আবগারি কর বছরে একবারই কাটা হবে। তা সেই হিসাবে আসলে কোনো সঞ্চয় থাকুক কিংবা না থাকুক। এভাবে টাকা আদায় করা অঘোষিত আয়কর ছাড়া আর কী? আবার যেভাবে স্তর নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতে শতাংশের হিসাবে ছোট হিসাবধারীর ঘাড়ে বড় সঞ্চয়কারীর চেয়ে বেশি করের বোঝা চাপবে। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর তাই যথার্থই একে দিনদুপুরে ডাকাতি বলে অভিহিত করেছেন। কম আয় বা কম সঞ্চয়ের অধিকারী গ্রাহকের ওপর বেশি হারে করের বোঝা চাপানোর এই বৈষম্যমূলক প্রস্তাব সংবিধানে বর্ণিত সম-অধিকার নীতির পরিপন্থী কি না, সেই প্রশ্নও উঠতে পারে।

এমনিতেই বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে গ্রাহকদের ওপর নানা অজুহাতে নানা ধরনের খরচের দায় চাপিয়ে দেওয়া হয়। লেজার ফি, ব্যাংক কার্ড ফি, চেক বইয়ের ফি ইত্যাদি নানা বিষয়ের জন্য ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রতিবছর টাকা আদায় করে। অথচ বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই এগুলোর জন্য আলাদা কোনো মাশুল নেই। গ্রাহকের আমানত বিনিয়োগ করে ব্যাংক যা আয় করে, সেখান থেকেই তাদের এসব খরচ মেটানোর কথা। কিন্তু ব্যাংক পরিচালকদের সঙ্গে এক অদ্ভুত বোঝাপড়ার কারণে এগুলোর ক্ষেত্রে সরকারের কোনো নজর নেই। ব্যাংকে আমানত রাখার জন্য অন্যান্য দেশে যেখানে নানা ধরনের প্রণোদনা দেওয়া হয়, সেখানে বাংলাদেশে ঘটে তার উল্টো। এমনকি বেসরকারি ব্যাংক আইন সংশোধনের মাধ্যমে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে পরিচালকদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে।

একসময়ের বহুল প্রচলিত বিজ্ঞাপন ‘চঞ্চল টাকা অঞ্চলে (আঁচলে) রেখো না’ স্লোগানটি হারিয়ে গেছে অনেক আগেই। অস্বাভাবিক দ্রুততায় রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় যাঁরা বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন, তাঁদের সম্পদের সিংহভাগই পাচার হয়ে গেছে বিদেশি ব্যাংকে। সর্বসাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী, শুধু ২০১৪ সালেই পাচারের পরিমাণ হচ্ছে ৭২ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির হিসাবে ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে মোট পাচারের পরিমাণ ৬ লাখ ৬ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। পাচার হওয়া ওই সব সম্পদ ফিরিয়ে আনতে সরকারের কোনো উদ্যোগের কথা মন্ত্রীর বক্তব্যে নেই। কিন্তু নানা কৌশলে কথিত ঋণ খেলাপের মাধ্যমে দেউলিয়া হতে যাওয়া রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর মূলধন পুনর্গঠনে বাজেটে আবারও ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছেন অর্থমন্ত্রী। এই রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে বর্তমান অর্থমন্ত্রী ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রীয় কোষাগারের ১৪ হাজার কোটি টাকা দিয়েছেন। এ পর্যন্ত খেলাপিতে পরিণত হওয়া এবং অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

এমনিতেই বাংলাদেশে মানুষের ভবিষ্যতের নির্দিষ্ট হারে আয় নিশ্চিত করার তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। শেয়ারবাজারে গত তিন দশকে অন্তত দুবার যে ধরনের কারসাজির অভিজ্ঞতা বিনিয়োগকারীদের হয়েছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে সেটি যে সাধারণের আস্থা অর্জনে সক্ষম হবে, সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। সরকারের বিভিন্ন সঞ্চয়পত্রকে যাঁরা ভরসা মেনেছিলেন, সুদের হার কমানোর কারণে তাঁরাও দিন দিন আশাহত হচ্ছেন। সরকারি চাকুরে ছাড়া অন্য পেশাজীবীদের পেনশন-সুবিধা না থাকার কারণে ব্যাংকে আমানত রাখার তেমন কোনো বিকল্প নেই।

অথচ একদিকে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর রাজনৈতিক প্রভাবাধীন অনাচার, অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকে জবাবদিহি অবসানের এসব করুণ চিত্র ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্টের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু তার মধ্যেই কর ব্যবস্থায় এমন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, যা মানুষকে ব্যাংকবিমুখ করবে, সেটিই তো স্বাভাবিক। বাজেটের দর্শন, অগ্রাধিকার, বিভিন্ন বরাদ্দ নিয়ে আগামী দিনগুলোতে প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্ক হবে সন্দেহ নেই। কার্যকর বিরোধী দলহীন সংসদের ভেতরে বাজেটের খুঁটিনাটি নিয়ে যে খুব একটা বিশ্লেষণ ও বিতর্ক হবে, সেই ভরসা কম। কিন্তু সংসদের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো এবং বিভিন্ন বণিক সভা, পেশাজীবী গোষ্ঠী ও নাগরিক সমাজে বাজেট নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা হবে এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় হয়তো দু-একটি প্রস্তাব সংশোধনও হবে। প্রতিবছরই সে রকমটি হয়ে থাকে। আশা করি, সরকার ব্যাংক আমানতের ওপর আবগারি করের বিষয়টি অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যাহার করে নেবে। আমানতকারীদের পাপী বিবেচনা করে তাঁদের পাপক্ষয়ের মাধ্যমে পুণ্য অর্জনের চিন্তাটা অর্থমন্ত্রীর দ্রুত পরিত্যাগ করা উচিত।

লেখক: কামাল আহমেদ (সাংবাদিক)

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ