প্রথম আলো সম্পাদককে হাইকোর্টে হাজির হওয়ার নির্দেশ
রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমানকে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
পত্রিকাটির বিরুদ্ধে জারি করা রুলের উপর আদালতে দাখিল করা জবাব তার কিনা তা নিশ্চিত করার জন্যই তাকে হাজির হতে বলা হয়েছে।
সোমবার হাই কোর্টের বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি জাফর আহেমেদের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দিয়েছেন।
পত্রিকাটির বিরুদ্ধে জারি করা রুলের উপর শুনানিকালে আদালত এ আদেশ দেন।
এদিকে আদালত অবমাননা রুলের বিষয়ে মতিউর রহমান ও পত্রিকাটির যুগ্মসম্পাদক মিজানুর রহমান খান সোমবার জবাব দাখিল করেছেন। যথাযথভাবে এ জবাব দাখিল না করায় সোমবার আবার তা সংশোধন করে দাখিল করতে বলা হয়েছে।
আদালত বলেছেন, দুইজনের বিষয়ে যে হলফনামা জমা দেওয়া হয়েছে তা প্রায় একইরকম। মতিউর রহমান জেনেশুনে এটা দাখিল করেছেন কিনা সন্দেহ হয়। তাই তাকে আসতে হবে। তাকে বিব্রত করার জন্য আসতে বলা হচ্ছে না। তিনি জেনেবুঝে এটা দাখিল করেছেন কিনা তা তাকে বলতে হবে।
দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমান ও যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খানের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগে জারি করা রুলের উপর শুনানি অব্যাহত রয়েছে। আগামী মঙ্গলবার আবার সকাল সাড়ে ১০টায় শুনানি হবে। এজন্য মতিউর রহমান ও মিজানুর রহমান খানকে আদালতে হাজির থাকতে বলা হয়েছে।
আদালতে রুলের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, আহসানুল করীম, মো. আসাদুল্লাহ, এবিএম ওয়ালিউর রহমান খান, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। অফরদিকে প্রথম আলোর পক্ষে শুনানি করেন ড. শাহদীন মালিক।
কলাম লেখা ও প্রকাশের মাধ্যমে আদালত অবমাননার অভিযোগে দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান ও যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খানের বিরুদ্ধে গত ২ মার্চ রবিবার স্বতপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি জাফর আহমেদের হাইকোর্ট বেঞ্চ। একইসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. আবু তালেবের করা পৃথক এক আবেদনে ওই দুইজনের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগে পৃথকভাবে আরো একটি রুল জারি করেছেন। এই দুটি রুলের উপর ৬ মার্চ থেকে শুনানি শুরু হয়েছে।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ‘মিনিটে একটি আগাম জামিন কীভাবে?’ এবং পহেলা মার্চ ‘ছয় থেকে আট সপ্তাহের স্বাধীনতা’ শিরোনামে পর পর দু’দিন প্রথম আলো পত্রিকায় দুটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। মিজানুর রহমান খান নিবন্ধ দুটি লিখেছেন। এসব নিবন্ধে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। এই নিবন্ধের বিষয়টি আদালতের নজরে আসার পর আদালত আদেশ দেন। দুপুর ২টা ২৪ মিনিট থেকে বিকেল ৫টা ১২ মিনিট পর্যন্তু শুনানিকালে মিজানুর রহমান খান সংশ্লিস্ট আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকেন।
শুনানির সময় প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও যুগ্মসম্পাদক মিজানুর রহমান খানের ব্যাখ্যা আদালতে হলফনামা আকারে দাখিল করা হয়। তাদের পক্ষে মশিউর রহমান খান এটা দাখিল করেন। এরপর প্রথম আলোর পক্ষে ড. শাহদীন মালিক শুনানি করতে চাইলে প্রশ্ন তোলেন ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ ও অ্যাডভোকেট আহসানুল করীম। তারা বলেন, আদালত অবমাননাকারী ছাড়া অন্য কেউ হলফনামা দাখিল করতে পারে না। তাদের সঙ্গে একমত হন আদালত। এরপর আদালত হলফনামাটি সংশোধন করে আজ মঙ্গলবার সকালে দাখিল করার নির্দেশ দেন। পাশাপাশি শাহদীন মালিককে শুনানি শুরু করতে বলেন।
এরপর শাহদীন মালিক শুনানিতে বলেন, আদালত অবমাননা আইন-১৯২৬ বাতিল করে সরকার ২০১৩ সালে আরেকটি আইন করেছে। এই আইন হাইকোর্ট অবৈধ ও বাতিল বলে রায় দিয়েছেন। ফলে দেশে এখন আর আদালত অবমাননা আইন নেই। তাই আদালত অবমাননার জন্য আদালত কাউকে শাস্তি দিতে পারে না। সংবিধান অনুযায়ী আদালত অবমাননাকারীকে শাস্তি দিতে হবে আইন অনুযায়ী। যেখানে আইন নেই সেখানে শাস্তি দেওয়ার সুযোগ নেই। শাস্তি দিতে হলে সংসদে আইন করতে হবে। তিনি বলেন, সংবিধানে অষ্টম সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম কোর্ট রায় দেওয়ার পর সংবিধান পুনঃমুদ্রন করা হয়। ওইসময় ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছিলেন, অষ্টম সংশোধনী বাতিল হলে দেশে চতুর্থ সংশোধনী (বাকশাল) ফিরে আসবে। কিন্তু অষ্টম সংশোধনীর পর বাকশাল ফিরে আসেনি।
এসময় ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ বলেন, অষ্টম সংশোধনী বাতিল করার পর সরকার সংবিধান পুনঃমুদ্রন করেছিল। সেজন্য সংসদে আইন করার প্রয়োজন হয়নি। তিনি বলেন, আদালত অবমাননা আইন-২০১৩ বাতিল হলে সেই আইনে আগের আইন রহিত করার ধারাও বাতিল হবে। আর ওই ধারা বাতিল হলে আগের আইন বলবৎ হবে। এটা হলে ১৯২৬ সালের আইন এখনও বলবৎ রয়েছে বলে ধরে নিতে হবে।
এসময় শাহদীন মালিক বলেন, অষ্টম সংশোধনী সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করার পর পুনঃমুদ্রন করতে সুপ্রিম কোর্ট নিজেই আদেশ দিয়েছিলেন। একারণে জাতীয় সংসদে নতুন করে আইন করতে হয়নি। তিনি বলেন, পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম কোর্ট রায় দেওয়ার পর সরকার সংবিধান পুনঃমুদ্রন করেছিল। কিন্তু তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এরপর সরকার সংবিধান সংশোধন করতে জাতীয় সংসদে আইন পাশ করে এরপর সরকার সংবিধান প্রকাশ করে। তিনি মিজানুর রহমান খানকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর বিষয়ে বলেন, এতে সংবিধানের ৩৫ অুনচ্ছেদ অনুযায়ী মিজানুর রহমান খানের অধিকার খর্ব হয়েছে। সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ বহাল থাকাবস্থায় কারো অধিকার খর্ব করার অধিকার নেই। এসময় আদালত তার কাছে জানতে চান, পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে বিশেষ করে ইংল্যান্ডে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় কিনা তা জানতে চান। জবাবে শাহদীন মালিক হ্যাঁ-সূচক জবাব দেন।
ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ আদালতে বলেন, আদালত অবমাননা রুলের উপর মিজানুর রহমান খান যে জবাব দিয়েছেন তা আদালত অবমাননামূলক। তিনি তার নিবন্ধের বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে। এটা আরেকটি নিবন্ধ ছাড়া আর কিছু নয়। ব্যারিস্টার রোকন বলেন, রুলের জবাবে বলা হয়েছে, দেশে আদালত অবমাননা আইন নেই। তাই তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করে আদালত ভুল করেছে। তিনি কোনো ভুল করেননি। এছাড়া তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রাখায় তার অধিকার খর্ব হয়েছে বলে দাবি করেছেন। তিনি যেটা লিখিছেন তা পড়লে রক্ত টগবগ করবে। তিনি আপিল বিভাগ ছাড়া অন্য আদালতকে মানতে নারাজ। এসময় আদালত বলেন, তিনি নিম্ন আদালত বলতে হাইকোর্টকেই বুঝিয়েছেন।
ব্যারিস্টার রোকন বলেন, তিনি (মিজানুর রহমান খান) যে জবাব দাখিল করেছেন তা জেনেবুঝেই দাখিল করেছেন। তার ব্যাখ্যা পড়লে এটা স্পষ্ট হবে যে তিনি যা লিখেছেন তা আদালত অবমাননামূলক।
আহসানুল করীম বলেন, দেশের সকল সাংবাদিকদের প্রতি সম্মান রয়েছে। তাদের খাটো করার জন্য আমরা শুনানি করছিনা। তিনি বলেন, মিজানুর রহমান খানের অনেক ভাল ভাল লেখা আছে। কিন্তু তিনি বিচার বিভাগ নিয়ে যেটা লিখিছেন তা আদালত অবমাননামুলক। আদালতের রুলের জবাব দাখিল করেছেন তা আইনগতভাবে হয়নি। এর ভিত্তিতে শুনানি হতে পারেনা। তাকে সঠিকভাবে হলফনামা দাখিল করতে হবে। তিনি বলেন, মিজানুর রহমান খান যে জবাব দাখিল করেছেন তাতে তিনি বলেছেন, তার লেখায় আদালত অবমাননা হয়নি। তার লেখার বিষয়ে তিনি আইনগত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার এই ব্যাখ্যাও আদালত অবমাননামূলক।
তিনি বলেন, মিজানুর রহমান খান আদালত অবমাননা করেছেন। তাই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই ক্ষমতা আদালতের নিজস্ব ক্ষমতা। আদালত সংবিধান ও জনগনের অধিকার রক্ষা করবে।