নিজামীর সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি প্রসিকিউটরের
সিনিয়র রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক জামায়াতের আমীর মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়েছে।
তখন যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে সেসব অপরাধ সংঘটনে নিজামী ছিলেন ‘রিং লিডার’। তাই অপরাধের রিং লিডার হিসেবে নিজামীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দাবি করেন প্রসিকিউটর।
ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহমানের নেতৃত্বে তিন সদেস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত জামায়াত নেতা নিজামীর বিরুদ্ধে বুধবার যুক্তি উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটররা।
প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী, মোহাম্মদ আলী ও তুরিন আফরোজ যুক্তি উপস্থাপন শেষ করেন। তুরিন আফরোজ আইনি পয়েন্টে যুক্তি উপস্থাপন করার আগে অভিযোগের ওপর যুক্তি শেষ করেন প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী।
গত সোমবার থেকে শুরু করে প্রসিকিউশন নিজামীর বিরুদ্ধে ১৬টি অভিযোগের বিষয়ে দালিলিক ও সাক্ষীদের সাক্ষী-প্রমাণের যুক্তি শেষ করে মোট তিন কার্যদিবসে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। তবে আসামিপক্ষের যু্ক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে জবাবে পাল্টা যুক্তিতর্ক ও সমাপনী বক্তব্য উপস্থাপন করবেন প্রসিকিউশন।
আগামীকাল বৃহস্পতিবার নির্ধারিত দিনে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে নিজামীর বিরুদ্ধে মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া। এরপর আইন অনুসারে রায়ের দিন ধার্য করবেন ট্রাইব্যুনাল।
আইনি পয়েন্টে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, ঘটনা ঘটুক বা না ঘটুক উস্কানি দেওয়া হচ্ছে অপরাধ এবং ‘উস্কানি’ অপরাধ হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছে। একাত্তরে নিজামী বিভিন্ন সভা-সমাবেশে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন।
তুরিন আফরোজ বলেন, তিনি (নিজামী) সে সময় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের বিরুদ্ধে ইসলামী জিহাদের ডাক দিয়েছিলেন। ধর্মের আড়ালে জিহাদি আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।
শুধু তাই নয়, ধর্মের নামে তিনি মিথ্যাচার করেছেন। মুক্তিযুদ্ধকে ‘ধর্মযুদ্ধ’ হিসেবে তুলে ধরেছেন তরুণ ছাত্র সমাজের কাছে। পাকিস্তানকে দেখিয়েছেন ‘আল্লাহর ঘর’ হিসেবে।
তুরিন আফরোজ বলেন, পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করা তিনি চাইতেই পারেন। তাই বলে ধর্মের নামে মিথ্যা উস্কানি দিয়ে? জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করে? এই কি দেশপ্রেম? এ কেমন দেশপ্রেম যে, মতের বিরোধিতাকারীদের হত্যা করতে হবে?
তিনি বলেন, নিজামীর এই ভুলের ওপর দাঁড়িয়ে ভুলের ইমারত গড়ে তোলা হয়েছিল। কিন্তু একাত্তর এমন একটি সত্য, যে সত্যের ওপর দাঁড়িয়ে আজকে সে সময়ের মানবতাবিরোধীদের বিচার করা হচ্ছে। কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এ বিচার হচ্ছে না।
উদাহরণ দিয়ে তুরিন আফরোজ বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হিটলারের অনুসারী হওয়ায় নাজি পার্টির প্রত্যেক সদস্যকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী হিসেবে যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছেন, অবশ্যই তাদেরও বিচার হতে হবে।
নিজামীর ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের (সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি) দায় নিয়ে তুরিন আফরোজ একটি চিঠি উপস্থাপন করে ট্রাইব্যুনালের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট মৌলভীবাজারের ইসলামী ছাত্রসংঘের এক নেতার কাছে চিঠিটি লিখেছিলেন ইসলামী ছাত্রসংঘের কেন্দ্রীয় সভাপতি সিরাজুল ইসলাম মতলিব। চিঠিতে তিনি ইসলামী ছাত্রসংঘের সকল কর্মীকে আলবদর বাহিনীতে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
এমনকি চিঠিতে মতিউর রহমান নিজামীর নির্দেশ উদ্ধৃত করে তিনি লিখেছিলেন, যারা আলবদর বাহিনীতে যোগ দেবে না তাদের ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যপদ বাতিল করা হবে।
এ সময় তুরিন আফরোজ বলেন, মতিউর রহমান নিজামী ছাত্রজীবন থেকেই নেতৃত্বের জায়গায় ছিলেন। সে সময় থেকেই তার ব্যক্তিত্ব ছিল নেতৃত্বসুলভ। একাত্তরে শীর্ষ নেতৃত্বে থেকেই তিনি সব সময় নির্দেশ দিয়েছেন।
ট্রাইব্যুনালে আসামিপক্ষের প্রদর্শিত নথিপত্র থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মতিউর রহমান নিজামীর নেতৃত্বের মূল্যায়ন কেমন ছিল তাও তুলে ধরেন তুরিন আফরোজ। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের দ্য রয়েল ইসলামিক স্ট্র্যাটিজিক স্টাডিস সেন্টার ২০০৯ সালে বিশ্বের ৫০০ জন প্রভাবশালী ইসলামিক নেতার নাম প্রকাশ করে। সেখানে প্রথম ৫০ জনের নামের মধ্যে মতিউর রহমান নিজামীর নাম ছিল।
তুরিন আফরোজ বলেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি (নিজামী) একজন প্রভাবশালী ইসলামিক নেতা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। আর একাত্তরে ইসলাম রক্ষার নাম করেই ধর্মের অপব্যাখ্যা সাজিয়ে, মিথ্যা প্রচার করে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছেন।
এছাড়াও তুরিন আফরোজ আসামিপক্ষের প্রদর্শিত নথিপত্র থেকে ২০০৭ সালে ভারতের নিউজ ম্যাগাজিন ‘প্রোব’ (PROBE) এবং দৈনিক ‘দ্য টাইম অব ইন্ডিয়া’তে মতিউর রহমান নিজামীর দেওয়া সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ তুলে ধরেন।
একাত্তরের দায় স্বীকার করে কেন জামায়াত ক্ষমা চাইবে না? এমন প্রশ্নের উত্তরে সাক্ষাৎকারে নিজামী বলেছিলেন, যেদিন আদালতের রায়ে গোলাম আযম নাগরিকত্ব ফিরে পেয়েছিলেন, সেদিন বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেট থেকে র্যালি শুরু হওয়ার আগে গোলাম আযম একাত্তরের ভূমিকার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন।
তুরিন আফরোজ প্রশ্ন রাখেন, কেন সেদিন দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন গোলাম আযম?
এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো বিচারিক কার্যক্রমের শেষ ধাপ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হচ্ছে নিজামীর মামলায়। উভয়পক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও জেরা শেষে গত বছরের ৩ থেকে ৬ নভেম্বর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটররা। এরপর ৭ নভেম্বর থেকে চার দিন আসামিপক্ষের যুক্তিতর্কের জন্য দিন রাখা হলেও নিজামীর আইনজীবীরা আসেননি। ফলে ১৩ নভেম্বর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন সমাপ্ত বলে ঘোষণা দিয়ে রায় যেকোনো দিন দেওয়া হবে বলে মামলার রায় ঘোষণা অপেক্ষমান রাখেন ট্রাইব্যুনাল। তবে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের লিখিত যুক্ততর্ক জমা দিতে বলা হয়।
এরপর ১৪ নভেম্বর আসামিপক্ষ ট্রাইব্যুনালের আদেশ পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সুযোগ চাইলে ১৭ নভেম্বর থেকে ফের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় দেন ট্রাইব্যুনাল।
২০ নভেম্বর উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হলে নিজামীর মামলার রায় দ্বিতীয়বারের মতো অপেক্ষমাণ (সিএভি) রেখেছিলেন বিদায়ী চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবিরের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু রায় দেওয়ার আগেই গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর তিনি অবসরে চলে যান। এরপর থেকে প্রায় দুইমাস ট্রাইব্যুনাল-১ পুনর্গঠন না হওয়ায় নিজামীর মামলাসহ পাঁচটি মামলার কার্যক্রম শুধু তারিখ পরিবর্তনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
৫৪ দিন চেয়ারম্যানের পদ শূন্য থাকার পর গত ২৩ ফেব্রুয়ারি নিয়োগ পাওয়া নতুন চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রথম বিচারিক কার্যক্রম শুরু করেন। সেদিনই নতুন করে যুক্তিতর্ক শোনার সিদ্ধান্ত নিয়ে ১০ মার্চ প্রসিকিউশনের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য তারিখ নির্ধারণ করেন ট্রাইব্যুনাল।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগের মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন মতিউর রহমান নিজামীকে গ্রেফতার করা হয়। পরে একই বছরের ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়।
নিজামীর বিরুদ্ধে তদন্ত শেষে ৩৩৬ পৃষ্ঠার তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন তদন্ত সংস্থা। আর আনুষঙ্গিক কাগজপত্রসহ প্রায় আড়াই থেকে ৩ হাজার পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট তৈরি করা হয়।
তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০১১ সালের ১১ ডিসেম্বর মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষ। এতে তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হত্যা, খুন, ধর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৫টি অভিযোগ আনা হয়।
২০১২ সালের ৯ জানুয়ারি নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল।
ওই বছরের ২৮ মে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৬টি অভিযোগ এনে নিজামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। অভিযোগ গঠনকালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগের ১৫টির সঙ্গে ১৬ নম্বর অভিযোগে বুদ্ধিজীবী হত্যা যোগ হয়েছে।
নিজামীর বিরুদ্ধে ২০১২ সালের ২৬ আগস্ট থেকে গত বছরের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। তার বিরুদ্ধে তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক খানসহ ২৬ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। তবে সপ্তম সাক্ষী প্রদীপ কুমার দেবকে বৈরি ঘোষণা করে তাকে জেরা করেছেন প্রসিকিউশন।