যেখানেই থাকুন, কণ্ঠ মেলান: প্রধানমন্ত্রী
সিনিয়র রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ স্বাধীনতা দিবসে যখন জাতীয় প্যারেড ময়দানের লাখো কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গাওয়া হবে, তখন যে যেখানে থাকবেন, সেখান থেকেই ‘সোনার বাংলায়’ কণ্ঠ মেলানোর আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মঙ্গলবার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে স্বাধীনতা পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এই আহ্বান জানান।
এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য নয়জন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটকে চলতি বছরের স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়া হয়।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেন, “এই বাংলাদেশ, রক্ত দিয়ে আমরা স্বাধীন করেছি। এই বাংলাদেশকে আমরা ভালোবাসি। এই দেশই আমাদের। কাজেই এ দেশকে আরো সুন্দরভাবে আমরা এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।”
জাতীয় সংগীত গেয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়তে বুধবার সকালে সবাইকে জাতীয় প্যারেড স্কোয়ারে আমন্ত্রণ জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “দেশপ্রেম যেন অন্তরে অনুভূত হয় সেজন্যই আমাদের জাতীয় সংগীত। লাখো কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গাওয়া হবে, প্যারেড স্কোয়ারে।”
“সারা বাংলাদেশে সকল জায়গায়, যে যেখানে, যার যা প্রতিষ্ঠান- আমরা চাই সব জায়গায় জাতীয় সংগীত গাইবেন। এর মাধ্যমেই আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের দেশপ্রেম এবং দেশের মানুষের সাথে একাত্মতা ঘোষণা আমরা করতে পারব।”
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের মানুষ জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস চায় না, তারা শান্তি চায়।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “একটি বিষয়- আমি সত্যিই প্রশংসা করি… মনে হয়েছে ৭১-এ আমরা যেভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। সেভাবেই যেনো সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যারা লিপ্ত তাদের প্রতিহত করেছে। যার কারণে নির্বাচন হয়ে দেশে শান্তি ফিরে এসেছে।”
এই প্রথম বাংলাদেশে একটি সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষা হলো মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সে সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছে যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে। যে দলের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।”
সরকারের চেষ্টায় সবার জন্য কর্মক্ষেত্রে সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা স্মরণ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা হাসিনা বলেন, “জাতির জনকের দূরদৃষ্টি ছিল। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগারতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে উনি (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) লন্ডনে যান। সেখানে বসেই তিনি পরিকল্পনা করেন, যুদ্ধ করতে হবে। যুদ্ধ কীভাবে পরিচালিত হবে? কোথা থেকে অস্ত্র আসবে? কোথায় ট্রেনিং হবে? শরণার্থীরা কোথায় যাবে? মিত্র শক্তি কারা হবে? সব পরিকল্পনাই তিনি লন্ডনে বসে করে আসেন।”
সাবেক গণপরিষদ সদস্য মোহাম্মদ আবুল খায়েরকে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য এ বছর মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়া হয়েছে। ১৯৭১ সালের৭ মার্চ প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেকর্ড ও সংরক্ষণ করেছিলেন তিনি।
মরণোত্তর এ পুরস্কার পেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সময় কুমিল্লার পুলিশ সুপারের দায়িত্বে থাকা মুন্সি কবির উদ্দিন আহমেদ। সে সময় সেনানিবাসের ব্রিগেড কমান্ডারের হাতে জেলা পুলিশের অস্ত্রভাণ্ডারের চাবি দিতে তিনি অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। পরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দি অবস্থায় শহীদ হন মুন্সি কবির।
একাত্তরে বরিশালের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসাবে দায়িত্ব পালন করা শহীদ কাজী আজিজুল ইসলাম এবার মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন। পাকিস্তান সরকারের চাকরিতে থেকেও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় সহায়তা দিয়েছিলেন তিনি।
মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন আরো চারজন- খসুরুজ্জামান চৌধুরী, শহীদ এস বি এম মিজানুর রহমান, মোহাম্মদ হারিছ আলী ও ভাষা সৈনিক অধ্যক্ষ মো. কামরুজ্জামান।
১৯৭১ সালর ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন কিশোরগঞ্জের তখনকার মহকুমা প্রশাসক খসুরুজ্জামান চৌধুরী।
সরকারি চাকরিতে থাকা অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়া মিজানুর রহমান ১৯৭১ সালের ৫ মে পিরোজপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর হামলায় শহীদ হন।
আর মুক্তিযুদ্ধে তরুণদের সংগঠিত করতে ভূমিকা রাখা মোহাম্মদ হারিছ আলী মুক্তিযুদ্ধের ৫ নম্বর সেক্টরের অধীন জেলা সাব-সেক্টরের রেজিমেন্টাল মেডিকেল অফিসারের দায়িত্বও পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিভাগের এম এন এ ইনচার্জ হিসাবে দায়িত্বপালনকারী, ভাষা সৈনিক অধ্যক্ষ মো. কামরুজ্জামানও মরণোত্তর এ পুরস্কার পেয়েছেন।
স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছ্নে মুক্তিযুদ্ধে ৮ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক হিসাবে দায়িত্ব পালনকারী লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. আবু ওসমান চৌধুরীও। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ অধীনস্ত সেনাদল নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন তিনি।
সংস্কৃতিতে এবারের স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, যিনি মুক্তিযুদ্ধসহ সব গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনেই ছিলেন সক্রিয়।
আর কৃষি-গবেষণা ও উন্নয়নে অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটকে এবার ‘গবেষণা ও প্রশিক্ষণ’ ক্ষেত্রে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়া হয়েছে।
পুরস্কারপ্রাপ্ত বা তাদের প্রতিনিধিদের হাতে একটি করে পঞ্চাশ গ্রাম ওজনের ১৮ ক্যারোট সোনার পদক এবং সম্মাননাসূচক প্রত্যয়নপত্র তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী।
এর সঙ্গে নগদ পুরস্কার হিসাবে তাদের প্রত্যেককে দুই লাখ টাকা করে দেয়া হয়।
স্বাধীনতা পুরস্কার বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদক। ২৬ শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস সামনে রেখে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য এ পদক দেয়া হয়।
প্রদকপ্রাপ্তদের পক্ষ থেকে নিজের অনুভূতি তুলে ধরে আবু ওসমান চৌধুরী বলেন, “আমি তখন ছিলাম লাহোর সেনানিবাসে। ১৯৭০-এর নির্বাচনের পর আমি বুঝতে পারি পরিস্থিতি উত্তপ্ত হচ্ছে। আমি রাওয়ালপিন্ডি থেকে দুজন বাঙালি সদস্যের সহায়তায় ইপিআরে পোস্টিং নিয়ে দেশে চলে আসি।”
মার্চের উত্তাল দিনগুলোর কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, “কোনো নির্দেশ না পেয়ে ৮ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে সবুজ সংকেত মনে করে সবাইকে নিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করি এবং জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে সালাম জানাই।”
আবু ওসমান চৌধুরী ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে চুয়াডাঙ্গায় দায়িত্ব পান। ৩০ মার্চ তার নেতৃত্বে কুষ্টিয়া শত্রুমুক্ত হয়।
“স্বাধীনতার পর অনেক গুণীজনকে স্বাধীনতা পদক দেয়া হয়েছে। এই পদক যে কতো আনন্দের তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।”
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আয়োজনে এ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা।