আইডিয়ালে রমরমা অবৈধ ভর্তিবাণিজ্য
রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ বছরের তিন মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও আইডয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির চাপে অবৈধ শিক্ষার্থী ভর্তি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে বৃহস্পতিবার। এজন্য স্কুল কমিটির সভাপতির ও বেসামরিক বিমান ও পর্যটক মন্ত্রী রাশেদ খান মেননের সঙ্গে তার দফতরে বৈঠকে বসবেন সংশ্লিষ্ট কমিটি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন তিন মাস অতিবাহিত হওয়ার পর আর কোনো ছাত্র ভর্তি নিতে ইচ্ছুক না। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালী একটি মহল এবং স্কুলের কোচিং ও ভর্তি বাণিজ্যের সিন্ডিকেটের প্রবল চাপে মিটিং ডাকতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।
এ লক্ষ্যে বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টায় সচিবালয়ে মন্ত্রীর দফতরে এ সংক্রান্ত একটি সভা ডাকা হয়েছে।
বিষয়টি স্বীকার করে কলেজের অধ্যক্ষ ড. শাহানআর বেগম এবিসি নিউজ বিডিকে জানান, স্কুলের নানা বিষয় নিয়ে বৃহস্পতিবার একটি সভা ডাকা হয়েছে। তবে সভার নিদিষ্ট কোনো এজেন্ডা নির্ধারিত হয়নি।
ভর্তি সংক্রান্ত কোনো আলোচনা হবে না কিনা জানতে চাইলে তিনি জানান, অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনায় বসছি, সেখানে এই বিষয়টি আসলে আসতেও পারে।
স্কুলের অভিভাবক ও গর্ভনিং বডির বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার মূলত ভর্তির বিষয়টি নিয়েই আলোচনা করতে বৈঠক ডাকা হয়েছে। কোচিংবাজ শিক্ষক ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের চাপে রাশেদ খান মেনন ও অধ্যক্ষ এই বৈঠকটি করতে বাধ্য হচ্ছেন।
অভিভাবক ও শিক্ষকদের অভিযোগ, গর্ভনিং বডির কিছু অসৎ লোক অবৈধভাবে ভর্তি করাতে বিভিন্ন লোকজনের কাছে থেকে টাকা নিয়ে রেখেছে। জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ থেকে ক্লাস শুরু এবং এর আগেই ভর্তি সময় শেষ হলেও এখন পর্যন্ত তাদের ভর্তি করাতে পারেনি। এখন অভিভাবকদের চাপে ম্যানেজিং কমিটি সভাপতিকে এক ধরনের চাপ দিয়ে তাদের ভর্তিতে বাধ্য করাতে চায়।
সূত্র বলছে, রাশেদ খান মেনন বিষয়টিতে একেবারেই রাজি নয়।
বিষয়টি জানতে রাশেদ খান মেননকে কয়েকবার ফোন দিয়েও পাওয়া যায়নি।
ভর্তি সংক্রান্ত সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী, পয়লা জানুয়ারি থেকে এ ভর্তি কার্যক্রম শুরু করতে হবে। নিয়মানুযায়ী যদি কোনো শূন্য আসন থাকে তবে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রকাশ্য লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করতে হবে। এছাড়া বাকি ক্লাসগুলোতে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়।
স্কুল সূত্র বলছে, আইডিয়াল স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ভর্তির আর কোনো আসন নেই। এরপরও গর্ভনিং বডির ১৪ জন সদস্য অবৈধ ভর্তির জন্য স্কুলের সভাপতির ওপর চাপ সৃষ্টি করে চলেছেন। এর নেপথ্য কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের অভিভাবকের কাছ থেকে শিক্ষার্থী প্রতি গড়ে দেড় থেকে আড়াই লাখ করে টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। যে কারণে এই ভর্তি বাণিজ্যের ব্যাপারে এত বেপরোয়া সংশ্লিষ্টরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্কুলটি কয়েকজন অভিভাবক অভিযোগ করে বলেন. স্কুলটির প্রায় ১৯ হাজার অভিভাবক তাকিয়ে আছেন বৃহস্পতিবারে মিটিং এর দিকে। তারা জানান, এমনিতেই স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের গাদা-গাদি করে ক্লাস করতে হয়। নিয়মিত পরীক্ষা নিতে পারছে না শিক্ষকরা। এই অবস্থায় আরো দেড় থেকে দুই হাজার শিক্ষার্থী যদি ভর্তি করা হয় তবে অবস্থা কোন পর্যায়ে যাবে?
স্কুলটি একজন সিনিয়র শিক্ষক অভিযোগ করে বলেন, ভর্তি সংক্রান্ত দুর্নীতি এই প্রতিষ্ঠানে আছে। এর যত দায়ভার আছে সব আমাদের ওপর এসে পড়ে।
ভর্তির অনিয়মের দায়ে স্কুলটি অধ্যক্ষের এমপিও বর্তমানে স্থগিত রয়েছে। তারা অভিযোগ করে বলেন, অন্যায় করে একজন আর প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় আরেকজনের।
ভর্তি-বাণিজ্যের তৎপরতা বন্ধের দাবিতে গত সপ্তাহ স্কুলের সামনে ব্যানার টানিয়েছেন সাধারণ অভিভাবকরা। এসব ব্যানারে বলা হয়েছে, ‘আইডিয়াল স্কুলের সুনাম ও ঐতিহ্য রক্ষার্থে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ চাই’, ‘গভর্নিং বডির সদস্যদের ভর্তির কোটা বাতিলসহ ভর্তি-বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে।’
এ ব্যাপারে অভিভাবক ফোরামের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে কেউ কথা বলতে রাজি হয়নি। তারা জানান, বৃহস্পতিবার মিটিং কী হয় সেটি দেখে তবেই মুখ খুলবেন তারা।
তবে তাদের প্রত্যাশা, ছাত্র-ছাত্রীরা যেন ঠিকমতো পড়াশুনা করতে পারে সে পরিবেশের কথা স্কুল কর্তৃপক্ষ মাথায় রাখবেন।
সভাপতি ও সদস্যসচিবসহ (অধ্যক্ষ) স্কুলের জিবিতে মোট সদস্য ১৪ জন। এর মধ্যে প্রাথমিক শাখার নির্বাচিত সদস্য হলেন আহসান উল্লাহ মানিক ও সোহেল আহমেদ সিদ্দিকী, মাধ্যমিক শাখার নির্বাচিত সদস্য অধ্যাপক আমজাদ হোসেন ও এ কে এম আশরাফুজ্জামান খান, কলেজ শাখার নির্বাচিত সদস্য এস এম কামাল উদ্দিন ও মাহবুবুল আলম এবং নির্বাচিত দাতা সদস্য হলেন খন্দকার মোস্তাক আহমেদ।
তারা সরাসরি অভিভাবকদের ভোটে নির্বাচিত। এছাড়া গভর্নিং বডির অন্য সদস্যদের মধ্যে সংরক্ষিত মহিলা সদস্য নার্গিস হোসেন, কো-অপ্ট সদস্য গোলাম আশরাফ তালুকদার এবং তিনজন শিক্ষক প্রতিনিধি।
এ স্কুলে অবৈধ ভর্তি চালু হয় ২০০৯ সালে। ওই সময় এসব অনিয়মের দায়ে ৮ জন শিক্ষক বহিষ্কার হলেও রহস্যজনকভাবে তারা স্বপদে ফিরে আসেন। এই সময় প্রায় ৪ শতাধিক শিক্ষার্থী অবৈধভাবে ভর্তি করা হয়। এরপর ২০১০ সালে অবৈধ ভর্তির সংখ্যা বেড়ে ৭ শতাধিক, ২০১১ সালে সহস্রাধিক, ২০১২ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ১২ শতাধিক। এই চারটি বছরই ক্লাস শুরুর ২ থেকে ৩ মাস পর ভর্তি করা হয়।
অভিভাবক সূত্র জানায়, এবছরের অবৈধ ভর্তি নিয়ে তৎপরতা শুরু হলে ফুসে ওঠে অভিভাবকরা। সাধারণ শিক্ষক, দু’জন জিবি প্রতিনিধি ও অভিভাবকরা ভর্তি-বাণিজ্যের বিরুদ্ধে সরব অবস্থান নিয়েছেন। বাধ্য হয়ে মন্ত্রণালয়ে মিটিং ডাকতে বাধ্য হয়েছেন রাশেদ খান মেনন।