ট্রাইব্যুনালের সঙ্কট কাটেনি ৪ বছরেও
সিনিয়র রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চার বছর পূর্ণ হয় গত ২৫ মার্চে। কিন্তু এখনও প্রসিকিউশনে এবং তদন্ত সংস্থার নানা সঙ্কট কাটেনি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রসিকিউটর টিম ও তদন্ত সংস্থার সদস্যরা।
তারা বলছেন, সরকার যুদ্ধাপরাধ তথা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে বলার পরও গত ৪ বছরে শুধু মামলার কার্যক্রম শেষে রায় ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু বিচারিক কাজ চালাতে যেসব সঙ্কট ছিল তা রয়েই গেছে। দেশের প্রয়োজনে এবং মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের দায় থেকে কাজ করলেও আমরা ঠিকমতো কাজ করতে পারছি না।
তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হলেও এখানে নেই কোনও গবেষণাগার ও লাইব্রেরী। সাপোর্ট দেওয়ার মতো কম্পিউটার ও টাইপরাইটার নেই। গত দুই বছর আগে প্রসিকিউশন টিমে নিয়োগ পাওয়া অনেক সদস্যদের বসার ব্যবস্থা করা হয়নি।
ট্রাইব্যুনাল গঠনের চার বছর হলেও এখানে নেই খাবারের কোনো ক্যান্টিন, আলাদা কোনও নামাজের ব্যবস্থা, সাংবাদিকদের জন্য উপযুক্ত মিডিয়া রুম। টয়লেটসহ অন্যান্য কক্ষগুলোর অব্যবস্থাপনার কোনও সুরাহা হয়নি। পেশাগত দায়িত্ব পালনে সংবাদ সংগ্রহের জন্য সাংবাদিকরা নিয়মিত ট্রাইব্যুনালে আসলেও সংকীর্ণ কক্ষে নেই পর্যাপ্ত চেয়ার।
চার বছরেও কাটেনি ট্রাইব্যুনালের জনবল সঙ্কট। এছাড়া কর্মকর্তাদেরকেও স্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। রেজিস্ট্রার অফিসের তথ্য মতে লোকবল থাকার কথা ৮২ জন। দিন মজুর ভিত্তিক কাজ করা কর্মচারীর সংখ্যা মাত্র ১৬ জন।
অপরদিকে বিভিন্ন পদে তদন্ত সংস্থায় লোকবল প্রয়োজন দুইশ ৪৭ জন। সেখানেও সংঙ্কটে ভুগছে সংস্থাটি। সব মিলেয়ে চরম ক্ষোভ রয়েছে প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থায়।
আন্তর্জাতিক মানের কথা বলা হলেও আন্তর্জাতিক মানের বই, লাইব্রেরী, গবেষণা নেই বলেও জানান তারা। ট্রাইব্যুনালের মামলার জন্য একটি ওয়েবসাইট করা হলেও নিয়মিত আপডেট করা হয় না। নেই কোনো নোটিশ বোর্ড। দেওয়া হয় না প্রতিদিনের মামলার কজলিস্ট। মামলার কজলিস্ট প্রদর্শনের জন্য ট্রাইব্যুনাল ভবনের মেইন ফটকে একটি ডিজিটাল মনিটর থাকলেও সেটি দুই বছর ধরে বন্ধ।
চার বছর পূর্তিতে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার নাসির উদ্দিন আহমেদ এবিসি নিউজ বিডিকে বলেন, ট্রাইব্যুনালের জনবল সঙ্কট এখন কাটার পথে। এছাড়া এক-দেড় মাসের মধ্যে কর্মকর্তাদের স্থায়ী নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হবে।
তিনি আরও বলেন, ওয়েবসাইট আপডেট করতে একজন আইটি বিশেষজ্ঞ রাখা আছে। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। এগুলো তো চলমান প্রক্রিয়া, তাই একটু সময় লাগছে বলেও জানান তিনি।
ট্রাইব্যুালের অব্যবস্থাপনা কতদিন নাগাদ সমাধান করা হবে জানতে চাইলে রেজিস্ট্রার বলেন, সব ঠিক হয়ে যাবে আস্তে আস্তে।
প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থা বলছে ২০১০ সালের ২৫ মার্চে গঠিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। পরে মামলার সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত বিচার করার জন্য গঠন করা হয় আরও এক ট্রাইব্যুনাল। দুই ট্রাইব্যুনাল মিলে পূর্ণ চার বছরে ৯টি রায়ে ১০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে (সাজা) দণ্ড দেওয়া হয়েছে।
তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন টিম থেকে বলা হয়, ট্রাইব্যুনালের বয়স চার বছর হলেও বিচারিক কার্যক্রম মূলত শুরু হয়েছে ২০১২ সাল থেকে। সে হিসেবে গত দুই বছরে এই মামলাগুলোর বিচার খুব দ্রুত সময়ে শেষ হয়েছে।
২০০৯ সালের ৯ জুলাই মানবতাবিরোধী তথা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস অ্যাক্ট) আইন ১৯৭৩ এর সংশোধনী আনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার।
সংশোধনী অনুযায়ী আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনাল) আইন ১৯৭৩ এর ৬ ধারার বলে একজন চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। পরে আসামীর সংখ্যা বাড়ায় বিচার দ্রুত শেষ করতে ২০১২ সালের ২২ মার্চ আরও একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়।
বর্তমানে নিজামীসহ সাতটি মামলা বিচারাধীন। আব্দুল কাদের মোল্লার আপিল নিষ্পত্তি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। আরও ছয়টি মামলা আপিল বিভাগে বিচারাধীন।
ট্রাইব্যুনাল গঠন ও বিচার কাজের স্বচ্ছতা, আন্তর্জাতিক মান রক্ষা নিয়ে শুরু থেকেই দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংগঠনের সমালোচনার মুখে পড়ে।
২০১২ সালের ২৮ আগস্ট ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন বিচারক একেএম জহির আহমদ। এরপর বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনকে নিয়ে আসা হয় ট্রাইব্যুনাল-১ এ।
স্কাইপি কেলেঙ্কারির দায় নিয়ে ২০১২ সালের ১১ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকও পদত্যাগ করেন। অতঃপর গত ১৩ই ডিসেম্বর বিচারপতি ফজলে কবীরকে ট্রাইব্যুনাল-২ থেকে ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। স্কাইপি কেলেঙ্কারির পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রম।
নিজামীর মামলার রায় না দিয়ে ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর অবসরে যান। এরপর হাইকোটের্র বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহীমকে চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দিয়ে বর্তমানে কার্যক্রম চলছে।
চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু এবিসি নিউজ বিডিকে বলেন, গত চার বছরে আমাদের অর্জন ও ব্যর্থতার মধ্যে আমাদের অর্জনই অনেক। আমি তাতে সন্তুষ্ট। আমরা প্রতিটি মামলায় নির্দিষ্ট প্রমাণপত্র দাখিল করেছি, যা আদালতে গ্রহণযোগ্য এবং সেই মর্মে রায়ও হয়েছে।
সৈয়দ হায়দার আলী এবিসি নিউজ বিডিকে বলেন, পৃথিবীর কোনো যুদ্ধাপরাধের বিচার এতো দ্রুত নিষ্পত্তি হয়নি। কোনো আদালতেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মামলার নিষ্পত্তি করা সহজ সাধ্য না। তবে আমরা তা পেরেছি।
তিনি বলেন, ২০১১ সালের জুলাই মাসে কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থার বৈঠক হয়। বৈঠকে অর্থ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টরা ট্রাইব্যুনালে জনবলসহ সকল বিষয়ে অগ্রাধিকারের সঙ্গে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না।
ট্রাইব্যুনালের গবেষনাগার এবং লাইব্রেরীর বিষয়ে জানতে চাইলে সৈয়দ হায়দার আলী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এখানে যে মানের বিচার হচ্ছে সে হিসেবে কেমন লাইব্রেরী থাকার কথা সেটা বিচার সংশ্লিষ্ট সকলেরই জানা থাকার কথা। আমাদের বসার স্থানই ঠিকমতো নেই তার আবার গবেষণা। গবেষণার কাজ আমরাই করি। তিনি বলেন, যেখানে লাইব্রেরী নেই তার আবার লাইব্রেরিয়ান।
তিনি বলেন, লাইবেরীতে বই বলতে নেই। তাই আমাদের মামলায় সহযোগিতা নিতে সুপ্রিমকোর্টের অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে ধর্না দিতে হয়। সরকার বিচারের শুরুতে অগ্রাধিকারের কথা বললেও আমর তা পাচ্ছি না।
রানা দাস গুপ্ত বলেন, আমরা দ্রুত সময়ে ৯টি মামলা শেষ করতে পেরেছি।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা প্রসিকিউটররা কী পেয়েছি। যা বেতন পাই তার সমান অর্থ(টাকা)মাসের ছয়-সাত দিনেই আয় হতো। আগের ছয়-সাত দিনের রোজগার এক মসের অনারিয়মের সমান। এ রকম পরিস্থিতিতে আমরা চলছি।
রানা দাস গুপ্ত বলেন, লাইব্রেরীতে আলমারী আছে তাতে বই নেই।
এ পরিস্থিতিতে মো. আলী, মোখলেসুর রহমান বাদল, সুলতান মাহমুদ, সাইফুল ইসলাম, আব্দুর রহমান হাওলাদার ও তুরিন আফরোজসহ সকলেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খান বলেন, এ চার বছরে যে ৯টি মামলার রায় হয়েছে তাতে আমরা সন্তুষ্ট। তবে শুরু থেকেই যদি আমাদের জনবল সঙ্কট না থাকতো তাহলে মনে হয় রায়ের সংখ্যা আরও বেশি হতো।
জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সানাউল হক বলেন, সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিলেও, তা মুখে মুখে বাস্তবে নয়। আমরা সন্তুষ্ট পয়সা ছাড়া। অথচ বিশ্বের অন্যান্য ট্রাইব্যুনালে ডলার, পাউন্ড খরচ করার পরেও ছয় সাত বছরে মাত্র এক-দুটি মামলার রায় হয়। আমাদের তদন্ত সংস্থার লোকবল প্রয়োজন ২শ ৪৭ জন অথচ তা নিয়োগ দেওয়ার কোনও খবর নেই।