সরকারের চাপে দায় এড়াতে নাকি ছুটিতে সিইসি?
সিনিয়র রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ সারা দেশে চলছে উপজেলা নির্বাচন। এ অবস্থায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদ এক মাসের ছুটিতে পাড়ি জমালেন যুক্তরাষ্ট্রে। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে কানাঘুষার অন্ত নেই। নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের অযাচিত হস্তক্ষেপের ব্যাপারে সন্তেুাষজনক সমঝোতা না হওয়ায় ‘বাধ্যতামূলক ছুটিতে’ পাঠানো হয়েছে সিইসিকে। নাকি ‘দায় এড়াতে’ নিজেই দেশ ছেড়েছেন কমিশন প্রধান। এমন সব প্রশ্নে আলোচনায় সরব বিভিন্ন মহল।
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, এক মাসের ছুটিতে যাচ্ছেন জানিয়ে গেছেন সিইসি। তবে উপজেলা নির্বাচন চলাকালে সিইসি দেশে থাকবেন না, এটা কল্পনায়ও ছিল না তাদের।
কর্মকর্তারা আরও বলেন, নানা মহলের নানা গুনজনের সমাপ্তি ঘটাতে পারেন কেবল সিইসি। আর তার জন্য তার ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষাও করতে হবে।
সত্যিই কি তিনি নিজেকে বাঁচাতে ছুটিতে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেলেন? নাকি সরকারের প্রভাবশালীর নেতার ইচ্ছায় বাধ্য হয়েই গেলেন?
‘এক মাসের ছুটিতে যাওয়া মানে অনেকটা পদত্যাগের মতো’ সিইসিকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের এমন বক্তব্য রাজনীতির আগুনে ঘি ঢালার মতো।
উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে বিএনপি এগিয়ে থাকায় সরকার অনেকটা বিব্রতর অবস্থায় পড়ে। আবার তৃতীয় ধাপের ভোট শুরু আগে সিইসি চলে গেলেন বিদেশে এরপরই বেড়ে গেল সহিংসতা। জিতেও গেল সরকার।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কমিশনার এবিসি নিউজ বিডিকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা এবং সাবেক একজন মন্ত্রীর আচরণে কমিশন রীতিমতো বিব্রতই নয় স্বাধীনভাবে কাজ করাও কষ্টসাধ্য।
২৩ মার্চ চতুর্থ দফার ভোটে বিএনপি সমর্থিতদের তুলনায় সরকার সমর্থিতরা জিতেছে দ্বিগুণেরও বেশি উপজেলায়। কিন্তু এই ফল উল্টো সরকারের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। কারণ, ১৫ থেকে ২০টি উপজেলায় সরকার সমর্থকদের বিরুদ্ধে কেন্দ্র দখল করে সিল মারার অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে ছবিও প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে। তবে ইসি এসব অভিযোগ পাত্তাই দেয়নি। উল্টো ভারপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক চতুর্থ দফার ভোটকে বলেছেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, নির্বাচন ভালো হয়েছে।’
সিইসির দায়িত্বে থাকা আবদুল মোবারক এবিসি নিউজ বিডিকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু নাই তাতেও দেশ চলছে, জিয়াউর রহমান নাই তাতেও বিএনপি চলছে। একইভাবে সিইসি না থাকলেও নির্বাচন ঠিকই হচ্ছে। আমি না থাকলেও তাই হবে।’
এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বলেন, ‘দায় এড়াতে সিইসি যদি বাইরে গিয়েও থাকেন তাতেও প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হবে।’
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ মনে করেন, ‘ইসির নীরবতায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সেই পুরনো ভোট জালিয়াতি ও শক্তি প্রয়োগের সংস্কৃতি ফিরে পেল। প্রশাসনের সহায়তায় সরকারি দলের কর্মী-সমর্থকরা ব্যালট ছিনতাই করছে, বুথ দখল করে সিল মারছে তা মিডিয়ায় প্রকাশ পাচ্ছে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) সহকারি রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের সমালোচনা করে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘কোনো ইউএনওর পক্ষে উপজেলা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ নয়। কারণ তারা একই সঙ্গে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী।’
এদিকে, বিএনপিও বলছে, নির্বাচন কমিশন সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সিইসির ছুটিই তা প্রমাণ করে।
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ বলছে, সিইসি এমন একটি পদে আছেন যেখান থেকে প্রধানমন্ত্রী চাইলেও তাকে সরাতে পারবেন না। তিনি যা করছেন নিজের ইচ্ছাতেই করছেন। সরকার তাকে বিদেশে পাঠিয়েছে- বিএনপির এমন বক্তব্যের কোনো ভিত্তি নেই।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, চার দফা নির্বাচনে অনিয়ম ও ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের ঘটনায় ১০৩টির মতো ভোটকেন্দ্র স্থগিত করা হয়। চতুর্থ দফা নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও সহিংসতার অভিযোগে তিনটি উপজেলায় ভোট স্থগিত করা হয়। প্রথম ধাপে ১০, দ্বিতীয় ধাপে ৩৫, তৃতীয় ধাপে ২৬টি, চতুর্থ ধাপে ৩২টি ভোটকেন্দ্র স্থগিত ছিল।
এর আগে দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের দিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় নোয়াখালী সদর এবং তৃতীয় ধাপের নির্বাচনের আগেই গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা নির্বাচন স্থগিত করা হয়।
তবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী উপজেলা নির্বাচনের চার ধাপে মোট ৬০৩ কেন্দ্রে অনিয়মের ঘটনা ঘটে।
এরজন্য অভিযোগের তীর বরাবরই ইসিসহ ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, সাংসদ ও নেতাকর্মীদের দিকে। তবে সিইসির অনুপস্থিতির কারণে নির্বাচনে সহিংসতার দায় মানতে নারাজ দায়িত্বপ্রাপ্ত সিইসি আবদুল মোবারক।
তিনি বলেন, ‘সিইসি নেই এজন্য সহিংসতা হচ্ছে এসব অমূলক যুক্তি। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। এখন যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে সেগুলো রেকর্ড করে রাখছি। আইন লঙ্ঘনের দায়ে এক সময় না একসময় বিচারের মুখোমুখি হতেই হবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ধারাবাহিক পরাজয় ঠেকাতে ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। গত পাঁচ বছরে নির্বাচন কমিশন অনেক স্থানীয় সরকার নির্বাচন করেছে। কিন্তু কোথাও নিরপেক্ষতা নিয়ে খুব বেশি প্রশ্ন কেউ তুলতে পারেনি। এখন উপজেলা নির্বাচনে সরকারের অবৈধ হস্তক্ষেপের কারণে নির্বাচন কমিশনকে অনেক ধকল পোহাতে হচ্ছে। ভবিষ্যতেও এ নিয়ে কথা তোলা হবে। তাই কমিশন চাচ্ছে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হোক। এ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে কমিশনের সম্পর্কের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন।
কমিশনের ভাষ্যমতে, প্রথম দফা নির্বাচন মোটামুটি সুষ্ঠু হলেও পরের দুই দফা নির্বাচনের পরিবেশ ছিল বেশ উত্তাল। ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনী ফল নিজেদের অনুকূলে রাখতে নির্বাচনে প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপ শুরু করে। এতে ফলাফলের চিত্রও পাল্টে যায়। এ পর্যন্ত নির্বাচনী সহিংসতায় আটজন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন পাঁচ শতাধিক। এর মধ্যে দ্বিতীয় ধাপে একজন, তৃতীয় ধাপে তিনজন এবং চতুর্থ ধাপে চারজন নিহত হন।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুসারে, এ পর্যন্ত ৩৭৯টি উপজেলার ফলাফলে আওয়ামী লীগ জয় পেয়েছে ১৭২টি, বিএনপি ১৪০টি, জামায়াত ৩৩টি এবং অন্যরা জিতেছেন ৩৪টি উপজেলায়। এ ফলাফলের তথ্যানুসারে সহিংসতার তীব্রতায় আওয়ামী লীগের জয় বেড়েছে। অপরদিকে, সহিংসতার মাত্রা যত কমছিল জয় ততো বিএনপির অনূকুলে ছিল।