ভিওআইপিতে পৌনে ৬’শ কোটি টাকা লুট!
অবৈধ ভিওআইপির মাধ্যমে প্রায় পৌনে ৬শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বিটিসিএল ও এরিকসনের প্রতারক চক্র। ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকলের (ভিওআইপি) মাধ্যমে এ দুই প্রতিষ্ঠানের একটি চক্র আন্তর্জাতিক কলের রেকর্ড গায়েব করে এ টাকা হাতিয়ে নেয়। সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে গত ৫ ফেব্রুয়ারি অনুসন্ধান টিম মামলার অনুমোদন চেয়ে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার দু’মাস পার হলেও কমিশন এখনও মামলার অনুমোদন দেয়নি।
অভিযোগ রয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন চাওয়া হয়েছে তারা দুদকের মামলা ঠেকাতে বিভিন্ন তদবির করছেন।
দু’মাস শেষ হলেও মামলার অনুমোদন না দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের অন্যতম প্রধান এক নির্বাহী বলেন, ‘‘এটি স্পর্শকাতর বিষয়। এ নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না। কমিশন যাচাই বাচাই করছে।”
বিটিসিএল এর আন্তর্জাতিক এক্সচেঞ্জ এবং এর ইউনিট অফিস, কম্পিউটার সেন্টার পরিদর্শন করে অনুসন্ধান টিম তথ্য পেয়েছে, বিটিসিএল-এর আইটিএক্স-৫ এবং আইটিএক্স-৭ হতে যে পরিমাণ কল প্রেরণ করা হয়েছে তা সঠিকভাবে রেকর্ড না করে কলডাটা মুছে ফেলা হয়েছে। এ জালিয়াতির কারণে প্রকৃত ইনকামিং কলের তুলনায় আইটিএক্সে (ইন্টারন্যাশনাল ট্রাঙ্ক এক্সচেঞ্জ) প্রদর্শিত কলডাটার পরিমাণ অনেক কম।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ভিওআইপি কেলেংকারির বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে বড় এ দুর্নীতির প্রমাণ পায়।
জানা গেছে, ২০১১ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় পৌনে ৬শ’ কোটি টাকার কল মুছে ফেলা হয়েছে। এতে সরকার বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন থেকে বঞ্চিত হয়েছে মনে করছে দুদক।
এ ঘটনায় মোট দশজনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান টিম কমিশনে মামলার অনুমোদন চেয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে দুদকের টিম মামলার অনুমোদন চেয়েছেন তারা হলেন, এরিকসন বাংলাদেশ লিমিটেড-এর কনট্রাক্ট ম্যানাজার আসিফ জাহিদ, রিলেশন ম্যানেজার নজরুল ইসলাম এবং প্রকৌশলী মাসরুরুল হাকিম।
এছাড়া বিটিসিএলের যে সাতজনের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন চাওয়া হয়েছে তারা হলেন, এডিই রোনেল চাকমা, ডিই মো: বদিউল আলম, জিএম (ওটিআর) মো: হাবিবুর রহমান প্রামানিক, সদস্য আনোয়ারুল মামুন, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ তৌফিক, ড. মো: আবু সাঈদ খান ও আজিজুল ইসলাম।
বিটিসিএলের যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন চাওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে একাধিক রয়েছে দুদকের দায়ের করা পূর্বের মামলার আসামি।
দুদকের অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ওই সিন্ডিকেট বিভিন্ন ক্যারিয়ারের বৈদেশিক ইনকামিং কলের তালিকা মুছে ফেলে অবৈধভাবে বৈদেশিক ক্যারিয়ার নিয়োগ এবং লোকাল এজেন্টদের মাধ্যমে বৈদেশিক ক্যারিয়ার থেকে প্রতিদিন মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ জানিয়ে টেলিযোগাযোগ সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি গত মার্চ মাসে একটি প্রতিবেদন দুদকেও পাঠায়।
ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মোট আন্তর্জাতিক কলের অর্ধেক কল বাইপাস করা ও সিডিআর মুছে ফেলা হচ্ছে। এক্সচেঞ্জ অফিসগুলো প্রতিদিন কল ভলিউম প্রতিবেদন বিটিসিএলের কাছে জমা দিতে বাধ্য থাকলেও তা জমা হচ্ছে না। যান্ত্রিক ত্রুটি দেখিয়ে রেকর্ড পাওয়া যায়নি বলে দায়িত্ব এড়িয়ে যান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
দুদকের অনুসন্ধানী দল অনুসন্ধান করে দেখতে পান যে, মহাখালীর এক্সচেঞ্জে ২টি আইটিএক্স (ইন্টারন্যাশনাল ট্রাংক এক্সচেঞ্জ) বা সাবস্টেশন রয়েছে। যা আইটিএক্স-৫ এবং আইটিএক্স-৭। দীর্ঘ অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য, বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বক্তব্য থেকে দুদক জানতে পেরেছে, বিটিসিএল কড়াইল (বনানী) অবস্থিত আন্তর্জাতিক এক্সচেঞ্জেরে মাধ্যমে বিদেশ থেকে আসা কলের ক্ষেত্রে অবৈধ ভিওআইপির মাধ্যম কল ডাটা ম্যানুপুলেট করে কল টার্মিনেট করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে দুদক আরও প্রমাণ পায় যে, আইটিএক্স-৫ এর কল ডিভাইস সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হতো না, প্রায়শই ডিভাইস অকার্যকর বা বিকল করা হয়েছে। অপরদিকে আইটিএক্স ৭ এর সিডিআর সঠিকভাবে জেনারেট করা হয়নি অর্থ্যাৎ বিশেষ প্রক্রিয়ায় কলডাটা মুছে ফেলা হয়েছে। এর পাশাপাশি দুটো আইটিএক্স এ ইনকামিং কলের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত অবৈধ একটি ‘বি’ টেবিল তৈরি করে এবং প্রতিটি আইটিএক্স এ (আইটিএক্স-৫ এবং আইটিএক্স-৭) দুটো করে অবৈধ রুট চালু রেখে বৈদেশিক ইনকামিং কল বাইপাস করা হয়েছে। দুদকের অনুসন্ধান টিমের পাশাপাশি বিটিসিএলের বিভাগীয় তদন্তেও এর প্রমাণ পাওয়া গেছে।
দুদক মনে করছে, বিটিসিএলের উচ্চ পর্যায়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তা এবং এরিকসনের সহায়তা ছাড়া প্রযুক্তি নির্ভর এ অনৈতিক কাজ সম্পাদন করা সম্ভব নয়।
প্রসঙ্গত, বিটিসিএলের ভিওআইপির কেলেংকারির বিষয়ে দুদকের উপ-পরিচালক এস এম সাহিদুর রহমানের নেতৃত্বে একটি টিম অনুসন্ধান করছেন।