৯০ ভাগ আসামি খালাস পায় পুলিশ ও পিপিদের অবহেলায়
সিনিয়র রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ রাষ্ট্রের পুলিশ ও পাবলিক প্রসিকিউটরদের (পিপি) অবহেলার কারণে ঢাকার নিম্ন আদালতের বিচারাধীন মামলার ৯০ ভাগ আসামিই খালাস পেয়ে যাচ্ছে। অথচ আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই ৯০ ভাগ আসামির সাজা হয়ে থাকে। পুলিশ ও পিপিরা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
আদালত সংশ্লিষ্টরা জানান, মামলা দায়েরের পর পুলিশ আসামির কাছ থেকে টাকা খেয়ে দুর্বল অভিযোগপত্র দেয়। আর দুর্বল অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে কোনো কথা না বলে উল্টো আসামিদের কাছ থেকে অনেক ক্ষেত্রে পিপিরা পয়সা নিয়ে থাকেন। পুলিশ ও পিপিদের এমন অনিয়মের কারণে আসামিদের বিচার হচ্ছে না। খালাস পেয়ে ফের তারা হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের ফৌজদারি অপরাধ করে যাচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, পুলিশের দেয়া দুর্বল অভিযোগপত্রের সুযোগ নিয়ে থাকে আসামি পক্ষ। মামলা দায়েরের পর অনেক তদন্ত কর্মকর্তা আসামি পক্ষের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে যেনতেনভাবে তদন্ত রিপোর্ট আদালতে জমা দিয়ে থাকে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের পিপিরা সঠিকভাবে আদালতে সাক্ষীদের উপস্থাপন করেন না। আসামিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হন তারা। দুর্বল তদন্ত রিপোর্ট ও সাক্ষীদের সঠিক সাক্ষ্য না দেয়ার কারণে আদালতের আসামিদের খালাস দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
ঢাকা মহানগর হাকিম আদালত, ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালত, ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত, ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালত এবং ঢাকার বিশেষ জজ আদালতের সব মামলার নথিপত্র ঘেঁটে জানা গেছে এসব তথ্য।
নথিপত্র ঘেঁটে জানা যায়, শুধুমাত্র পুলিশ ও চিকিৎসক সাক্ষীর কারণে ঢাকার ২১ টি আদালতে প্রায় দুই হাজার হত্যা মামলার বিচারকাজ কার্যত বন্ধ রয়েছে। গত এক যুগে নিষ্পত্তি হওয়া ২২৩টি হত্যা মামলার মধ্যে ৮২টি মামলার আসামিরা খালাস পেয়েছেন। পুলিশ ও আইন কর্মকর্তাদের চরম অবহেলায় ৯৬ ভাগ অস্ত্র মামলার আসামি আদালত থেকে খালাস পাচ্ছেন। সাজা পাচ্ছেন মাত্র ৪ ভাগ মামলার আসামি।
আদালতে পুলিশ সঠিক সাক্ষ্য না দেয়ার কারণে আসামিরা আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। যুগের পর যুগ পুলিশ সাক্ষী আদালতে আসছে না। যে কারণে ১২ হাজার ৫৪৭টি অস্ত্র মামলার বিচারকাজ বন্ধ। বিচার বিলম্বের জন্য দায়ী অন্তত ৫০ হাজার পুলিশ সাক্ষীকে চিহ্নিত করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এদের দৃষ্টান্তমূলক বিভাগীয় শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করে আদালতকে জানানোর জন্য স্বরাষ্ট্র সচিব ও আইন সচিব এবং পুলিশের প্রধানকে (আইজিপি) চিঠি দেয়া হয়েছে।
নথিপত্র ঘেঁটে আরও জানা যায়, মাদকের মামলায় ঢাকার ৯৩টি আদালত অন্তত দেড় লাখ পুলিশের বিরুদ্ধে অজামিনযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। আদালতে সাক্ষ্য দিতে না আসায় পুলিশের বিরুদ্ধে এ গ্রেফতারি পরোয়ানা অব্যাহত রেখেছেন আদালত। পুলিশ ও সাধারণ সাক্ষীরা না আসার কারণে ঢাকার এসব আদালতে ৬৫ হাজার মাদকের মামলার বিচারকাজ কার্যত বন্ধ রয়েছে। পুলিশ সাক্ষীদের হাজিরের জন্য আদালতগুলো ঢাকার মহানগর পুলিশ কমিশনার ও পুলিশের মহা-পরিদর্শককে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার নেয়ার আদেশ দিলেও তা উপেক্ষা করা হচ্ছে।
গত এক যুগে ঢাকার এসব আদালতে মাদকের মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ২৮টি। নিষ্পত্তিকৃত মামলার মধ্যে ৭০০ মামলার আসামিই খালাস পেয়েছে। শতকরা ৮ ভাগ মামলার আসামিরা সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। বাকি ৯২ ভাগ মামলার আসামি আদালতের মাধ্যমে খালাস পেয়েছে।
অপরদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলার ৮০ ভাগের বেশি আসামি আদালত থেকে খালাস পেয়ে যাচ্ছে। সাজা পাচ্ছে ২০ ভাগের কম মামলার আসামিরা। দুর্বল অভিযোগপত্রের সুযোগ নিয়ে আসামিরা আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন দায়ের করা মামলার নথিপত্র সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯২ সাল থেকে ২০১৩ পর্যন্ত যে দায়ের করা মামলার মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ৩৪০টির। এর মধ্যে ২৮০ মামলার আসামিরা খালাস পেয়ে গেছেন। বাকি ৬০টি মামলার আসামিদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। নিষ্পত্তিকৃত মামলার পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৮০ ভাগের বেশি আসামি খালাস পেয়ে গেছে।
আদালতের একাধিক বিচারবিভাগীয় কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তারা যদি মামলা প্রমাণের জন্য আন্তরিক না হন, তাহলে আসামিরা খালাস পাবেনই। অপরদিকে পুলিশ আসামিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সঠিকত তদন্ত রিপোর্ট আদালতে জমা দেন না।
প্রচলিত ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী, রাষ্ট্রকেই প্রমাণ করতে হয় আসামি দোষী। এ পদ্ধতির পরিবর্তন চান বিশিষ্ট আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল। তিনি বলেন,‘ প্রচলিত এ পদ্ধতি পরিবর্তন করা উচিৎ। বরং আইন করা উচিৎ, আসামিকে প্রমাণ করতে হবে তিনি দোষী নন। তাহলেই বিচার হবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইন কমিশনের উর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রে সাজার হার নব্বই ভাগ। আর বাংলাদেশে এর উল্টো। শতকরা ১০ ভাগ মামলার আসামিদের সাজা হয়ে থাকে। এটা খুবই দুঃখজনক। এর কারণ, পুলিশের দুর্বল অভিযোগপত্র। মামলার সঠিক তদন্তের জন্য দরকার দক্ষ তদন্ত কর্মকর্তার। পিপিদের সঙ্গে পুলিশের কোনো সম্পর্ক নেই। পুলিশ শুধুমাত্র তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েই ক্ষ্যান্ত।
এ প্রসঙ্গে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, দুর্বল তদন্ত রিপোর্ট মামলা খালাসের অন্যতম কারণ। পুলিশ ও প্রসিকিউশনের মধ্যে সমন্বয় সাধন না করলে কোনো লাভ হবে না। এ ছাড়া পিপিদের দলীয় ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে। ভারতসহ পৃথিবীর অনেক দেশে রেগুলার ক্যাডার সার্ভিসের মাধ্যমে পিপি নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে। এডিপি এ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজও করেছে। ক্যাডার সার্ভিসের মাধ্যমে পিপি নিয়োগ দেয়া হলে মামলার ফলাফল রাষ্ট্রের দিকেই আসবে।