বঙ্গবন্ধু হত্যায় সংশ্লিষ্টতার খবর বন্ধে ভারতের উপর যুক্তরাজ্যর চাপ

imadxges

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার খবর প্রকাশ বন্ধে ভারতের সংবাদমাধ্যমের ওপর জরুরি ভিত্তিতে বিধিনিষেধ আরোপে দেশটির সরকারের প্রতি চাপ দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকরা। ১৯৭৫ সালে সামারিক অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্টের মৃত্যু পরের মাসগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তারবার্তায় বিষয়টি উঠে আসে। গোপন এক তারাবার্তায় যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার দিল্লিতে তার দূত মারফত ভারত সরকারকে জানান, ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে আমরা আশা করি।’১৯৭৫ সালের জুন মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারি করেন এবং সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় এমন সংবাদ প্রকাশে শহরের সব ধরনের পত্রিকা ও সংবাদ সংস্থার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। সোমবার উইকিলিকস প্রকাশিত ১৯৭৩-৭৬ সালের যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রায় ১৭ লাখ তারবার্তার মধ্যে এ সংক্রান্ত কিছু তারবার্তায় এই তথ্য উঠে আসে। যদিও এগুলোকে ওই সময় গোপনীয় বলা হয়েছে, এখন সেগুলো উন্মুক্ত করা হয়েছে।
শেখ মুজিবকে হত্যার চার দিন পর ১৯৭৫ সালের ১৯ আগস্ট দিল্লিতে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম স্যাক্সবে’র প্রতিবেদনে বলা হয়, দূতাবাসের ভারপ্রাপ্ত উপ-প্রধান ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিবের কাছে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার একটি প্রতিবেদনের সমালোচনা করেছেন।
স্যাক্সবে তারবার্তায় লিখেন, ‘তার সহকর্মী যুগ্ম সচিবকে বলেছেন- বাংলাদেশের সামরিক অভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারকে জড়িয়ে ভারতের গণমাধ্যমে অব্যাহত অভিযোগের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর অবস্থান নেব। এ ধরনের অভিযোগ অবমাননাকর ও ভারত সরকারের নিজস্ব বিধিনিষেধের লঙ্ঘন, এবং এটি যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করবে।’
তারবার্তায় বলা হয়, ‘এধরনের অভিযোগ সংবাদ আকারে প্রকাশ বন্ধ করতে নিজস্ব বিধিবিধান প্রয়োগের পদক্ষেপ নিতে ভারত সরকার কেন প্রস্তুত নয় তা আমাদের বোধগম্য নয়। বাংলাদেশের ব্যাপারে লেখালেখির ক্ষেত্রে বিদেশি প্রতিনিধিদের সতর্ক করেছে ভারত সরকার। সুতরাং দূতাবাস আশা করে, নিজেদের সংবাদকর্মীদের বিষয়েও অন্তত তারা একই কাজটি করবে।’
এরও দুদিন পর ২১ আগস্ট স্যাক্সবে আরও একটি তারবার্তা পাঠান। এতে ভারতের ব্লিটজ ম্যাগাজিনে মুজিব হত্যার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা- সিআইএ’র সংশ্লিষ্টার অভিযোগ এনে প্রকাশিত প্রতিবেদনের সমালোচনা করা হয়
এতে তিনি বলেন, ‘সন্ধ্যায় মিসেস গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকে প্রতিবেদনটি আলোচনায় আনার পরিকল্পনা করেছেন সিনেটর ইয়াগলেটন।’ এ সময় সিনেটর ইয়াগলেটনকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেয়ার ঘটনাকে অবিশ্বাস রকমের মানসিক রোগ বলে ভারত সরকারের সমালোচনা করেন রাষ্ট্রদূত, কারণ তখনও ব্লিটজের মতো অবমাননাকর এবং সম্ভব্য ভয়ঙ্কর ধরনের অপপ্রচারকে প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছিল।
এর তিন মাস পর কলকাতার দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ দূতাবাসের ১৮ নভেম্বরের একটি তারবার্তায় রাষ্ট্রদূত বোস্টারকে ১৫ আগস্টে মুজিবের পতনের জন্য দায়ী করা হয়।
‘একটি বন্ধুভাবাপন্ন হিসেবে স্বীকৃত দেশের সরকারি দলের নিয়ন্ত্রিত পত্রিকায় এ ধরনের আক্রমণ হজম করা কঠিন’ তারবার্তায় বলা হয়।
এর জবাবে দুদিনের মধ্যে দিল্লি দূতাবাসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই তারবার্তা পাঠান। ২০ নভেম্বরের তারবার্তায় হেনরি কিসিঞ্জার লিখেন, উপ-সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাবস ওয়াশিংটনে ভারতীয় মিশনের উপ-প্রধানকে জানান, ‘রাষ্ট্রদূত বোস্টারের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক অভিযোগ দায়িত্বজ্ঞানহীন ও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন’ এবং তার উচিত নয়াদিল্লিকে জানানো- ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আগে থেকেই পদেক্ষপ নেয়া হবে আমরা এমনটাই আশা করছি।’  ‘তোমারও উচিত একই উদ্যোগ নেয়া’- একথা বলে তারবার্তাটি শেষ করেন কিসিঞ্জার। যুক্তরাষ্ট্র শহরটির (কলকাতা) ‘অধিকাংশ কুৎসিত আলোচনার’ বিষয়বস্তু- রাষ্ট্রদূত এমন ধরনের একটি তারবার্তা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর দুই সপ্তাহ পর যুগান্তরের প্রতিবেদনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস।

৬ নভেম্বর লেখা তারবার্তায় ডেভিস ইউগিন বোস্টার বলেন, ’১৫ আগস্টের সামরিক অভ্যুত্থানে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল এমন ধারণা ওই ঘটনার পর ব্যাপক প্রচার পায়। মোশতাক আহমেদের পশ্চিমাপন্থী এবং সোভিয়েত ও ভারত বিরোধী  পরিচিতি রয়েছে।এছাড়া সব বড় ঘটনায় অদৃশ্য (বিদেশিদের) হাত খোঁজার বিষয়ে বাঙালিদের মধ্যে তীব্র প্রবণতা দেখা যায় এবং মনে করা হয়, যেকোনোভাবে বা উপায়ে মুজিবকে উৎখাতে যুক্তরাষ্ট্র ভূমিকা রেখেছে।’এরপর তিনি বর্ণনা করেন, সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত ফোমিন থেকে উৎসাহ নিয়ে পরিচিতি পাওয়ায় বুলগেরিয়ার রাষ্ট্রদূত নিকোলাই বোয়াদজিভ কিভাবে একজন কূটনীতিককে বলেন, ‘মুজিবের মৃত্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া আর কোন দেশের কোনো লাভ হয়েছে?’ এবং তিনি অভিযোগ করেন, ‘চিলির ঘটনার সময়ও রাষ্ট্রদূত বোস্টার সেখানে ছিলেন।’ আরেকটি তারবার্তায় বোস্টারকে তার সহকর্মীদের বলতে দেখা যায়, ‘১৯৬৩ সালে তিনি একটা সময় চিলিতে তিন দিন ছিলেন। তবে তাকে সেখানে নিয়োগ দেয়া হয়নি।’
২০০৬ সালে বোস্টারের মৃত্যুর পরপরই সাংবাদিক লরেন্স লিফসুজ রাষ্ট্রদূত নিজেই তার ‘দ্য আনফিনিশড রেভ্যুলেশন’ বইয়ের সোর্স ছিলেন বলে দাবি করেন।
এতে অভিযোগ করা হয়, যারা মুজিবকে হত্যা করেছে, যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের যোগাযোগ ছিল।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ