জমজমাট ভাবে পালিত হচ্ছে নববর্ষ
রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ নতুন বাংলা বছরকে বরণ করে নিতে ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে জনসাধারণের প্রাণের উচ্ছ্বাসে যে বর্ণিল উৎসব ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে তার সূচনাতে এসেছে বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতির ধারায় সম্প্রীতির ডাক। প্রাণের এ উৎসবে মেতে ওঠেছে পুরো বাঙালি জাতি।
পূব আকাশে সূর্যোদয়ে চিরনতুনের ডাক দিয়ে আসা পহেলা বৈশাখ যেন রঙ ছড়িয়ে দিয়েছে বাঙালির মনে, যার প্রকাশ ঘটেছে নারী-পুরুষের রঙিন সাজে, শিশুর মুখে ফুটে ওঠা আনন্দের হাসি আর বর্ণিল পোশাকে।
সোমবার এভাবে নানা আয়োজনে, নানা আঙ্গিকে বাঙালি বরণ করছে বঙ্গাব্দ ১৪২১ কে, সকালে রাজধানীর রমনা বটমূলে ছায়ানটের পরিবেশনায় যার শুরু।
বরাবরের মতোই ভোর সোয়া ৬টায় সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রমনা বটমূলে শুরু হয় ছায়ানটের বর্ষবরণের আয়োজন। এর বেশ আগে থেকেই সেখানে দলে দলে সমবেত হতে থাকে মানুষ।
অনুষ্ঠান শুরুর পর জনতার ঢল নামে রমনায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই বটমূলের অনুষ্ঠানস্থল উপচে মানুষ ছড়িয়ে পড়ে আশপাশে। এক সময় পুরো রমনাই লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়।
অনুষ্ঠানের কথন পর্বে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ডাক দিয়ে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও ছায়ানট সভাপতি সানজীদা খাতুন বলেন, “উজ্জ্বল প্রশান্তি আমাদের লক্ষ্য। সম্প্রীতি বন্ধনেই তা অর্জন হতে পারে।”
‘কুশিক্ষাগ্রস্ত’ ধর্ম ব্যবসায়ীরা বিদেশ থেকে টাকা এনে তার থেকে সামান্য কিছু সাধারণ মানুষের একটি অংশকে দিয়ে তাদের দিয়ে নানা ধ্বংসাত্মক কাজ করাচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যথাযথ শিক্ষা দেয়া আমাদের কাজ নয়। কিন্তু ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা যে হানাহানি নয় তা বোঝাবার দায়িত্ব আমাদের। গান, কবিতা, নাটক ইত্যাদির মাধ্যমে আমাদের সে দায়িত্ব পালন করতে হবে।”
শিল্পী রাজরুপা চৌধুরীর ‘রাগ আহীর ভৈরবের’ মধ্য দিয়ে ছায়ানটের এই বর্ষবরণের অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপর সমবেত কণ্ঠে গাওয়া হয় কবিগুরুর হৃদয় খোলার গান।
‘এ কী সুগন্ধহিল্লোল বহিল/আজি প্রভাতে, জগত মাতিল তায়॥/হৃদয়মধুকর ধাইছে দিশি দিশি পাগলপ্রায়॥/বরণ-বরণ পুষ্পরাজি হৃদয় খুলিয়াছে আজি/সেই সুরভিসুধা করিছে পান/পূরিয়া প্রাণ, সে সুধা করিছে দান–/সে সুধা অনিলে উথলি যায়॥’।
এরপর সবারে ভালোবাসার ডাক দিয়ে গাওয়া হয় অতুল প্রসাদ সেনের ‘সবারে বাস রে ভালো/নইলে মনের কালো ঘুচবে নারে/আছে তোর যাহা ভালো/ফুলের মতো দে সবারে/নইলে মনের কালো ঘুচবে নারে’; গেয়ে শোনান শিল্পী ইফফাত আরা দেওয়ান।
এরপর একে একে পরিবেশন করা হয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জাগ আলসশয়নবিলগ্ন’, নজরুলের ‘ক্ষমা করো হযরত’, কবিগুরুর ‘অন্ধজনে দেহ আলো’।
এরপর আবৃত্তি করা হয়, মনজুরে মাওলার সম্প্রদায়িকতাবিরোধী কবিতা ‘রামু ২০১২: বৌদ্ধবিহার পুড়িয়ে দেয়ার পর’। কাজী নজরুলের লেখা ‘হিন্দু-মুসলমান’ পরিবেশনের পাশাপাশি গাওয়া হয় ‘মোরা এক বৃত্তে দুটি কুসুম’। সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী এসব পরিবেশনার পাশাপাশি সম্মিলিত কণ্ঠে গাওয়া হয়, ‘বল নাহি ভয়’। গাওয়া হয় লালন শাহের ‘এমন সমাজ কবে সৃজন হবে’।
রজনীকান্ত সেন, জনদেব সেন, অতুল প্রসাদ সেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সৃজন সেন, মতলুব আলী, সলিল চৌধুরী, আব্দুল করিম, জালালউদ্দিন খাঁ, শাহ আব্দুল করিম, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নানা রচনা একক ও সম্মিলিত কণ্ঠে পরিবেশন করা হয়।
অনুষ্ঠান শেষ হয় জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে।
লাল-সাদা শাড়ি, টিপ-আলতা আর ফুলে সেজে নানা বয়সের নারী, রঙিন পাঞ্জাবির পুরুষ আর বর্ণিল পোশাকে শিশুরা সকাল থেকেই রঙিন করে তোলে রমনার উৎসবকে।
কয়েকটি নিরাপত্তা স্তর পেরিয়ে রমনায় ঢুকতে হলেও তা নিয়ে অসন্তুষ্ট দেখা যায়নি কাউকে। ২০০১ সালে রমনায় বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে বোমা হামলার পর নিরাপত্তা জোরদার করা হচ্ছে প্রতিবছরই।
সকাল ৯টার আগে ছায়ানটের অনুষ্ঠান শেষ হতে না হতেই সবাই ছুটে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে শুরু হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা।
বাঙালির চিরায়ত উৎসব পহেলা বৈশাখকে স্বাগত জানাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের নিয়মিত আয়োজন মঙ্গল শোভাযাত্রায় শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীই নয়, দূর-দূরান্ত থেকে আসা অনেকেই যোগ দেন।
ইতিহাস বলে, রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য মুঘল সম্রাট আকবরের যুগে প্রবর্তন হয়েছিল বাংলা সালের। বর্ষ শুরুর সে দিনটিই এখন বাঙালির প্রাণের উৎসব।
বাদশাহ আকবরের নবরত্ন সভার আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজি বাদশাহী খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য ফসলি সালের শুরু করেছিলেন হিজরি চান্দ্রবর্ষকে সৌরবর্ষের মতো মিলিয়ে নিয়ে। তিনিই হিজরিকে বাংলা সালের সঙ্গে সমন্বয় করেন এবং পয়লা বৈশাখ থেকে বাংলা নববর্ষ গণনা শুরু করেন। আর বৈশাখ নামটি নেয়া হয় নক্ষত্র ‘বিশাখা’র নাম থেকে।
আকবরি আমলের খাজনা আদায়ের দিন গত হয়েছে বহু আগে। তবে আঙ্গিক বদলে রয়ে গেছে সেই উৎসব। তারই রং আজ শহর বন্দর গ্রামে, জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সব বাঙালির প্রাণে।