সুখরঞ্জন বালী কলকাতার কারাগারে

sukhronjonএবিসি নিউজ ডেস্ক, ঢাকাঃ একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পিরোজপুর থেকে সাক্ষ্য দিতে আসা সুখরঞ্জন বালী’র সন্ধান মিলেছে। বেচে আছেন তিনি। বন্দি জীবন যাপন করছেন কলকাতার একটি কারাগারে।

বাংলাদেশের ইংরেজি জাতীয় দৈনিক ‘নিউ এইজ’এ বুধবার (১৬ মে) রাত ১২টায় অনলাইনে এবং ১৬ মে সংখ্যায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

‘ওয়ার ক্রাইমস ট্রায়াল, উইটনেস অ্যালিজেস স্টেট অ্যাবডাকশন’ শীরনামের প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একজন সাক্ষী ছিলেন সুখরঞ্জন বালী। ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপহরণ করে বলে আসামিপক্ষ দাবি করে আসছিল। কলকাতার একটি কারাগারে তার খোঁজ পাওয়া গেছে।

প্রতিবেদনে সুখরঞ্জন বালীর বিবৃতির বরাতে বলা হয়, দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা পিরোজপুরের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক সুখরঞ্জন বালী, তাকে গত বছরের ৫ নভেম্বর সকালে ট্রাইব্যুনালের ফটক থেকে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তুলে নিয়ে যায় বলে নিশ্চিত করেছেন তিনি। ওইদিন জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন তিনি।

কারাগারে আটক অবস্থায় দেওয়া এক বিবৃতিতে বালী বলেন, তাকে আদালত চত্বর থেকে একটি পুলিশের গাড়িতে ‘অপহরণ’ করে পরে একটি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই অফিসের ডেস্কে একটি পেপার স্ট্যাম্পে কিছু শব্দ দেখে তিনি পরে ওই অফিসটি পুলিশের গোয়েন্দা শাখার বলে বুঝতে পারেন।

সুখরঞ্জন বালী কলকাতার দম দম সংশোধন কেন্দ্রে আটক রয়েছেন বলে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে তথ্য পায় নিউ এইজ পত্রিকা। পত্রিকা জানতে পারে সুখরঞ্জন বালীকে দেখতে তার পরিবারের সদস্যরা সেখানে গিয়েছিল। এরপর এ তথ্যের সত্যতা এবং কীভাবে তিনি সেখানে গেলেন তা নিশ্চিত করতে কাজ করে আসছিল পত্রিকাটি।

পত্রিকাটি তার সঙ্গে দেখা করতে এবং একটি বিবৃতি নিতে ওই কারাগারে প্রবেশে সক্ষম একজন ভারতীয় নাগরিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে। নিরাপত্তার কারণে তার নাম প্রকাশে অনিচ্ছার কথা জানায় ওই ব্যক্তি। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কোনো পক্ষের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা-সংশ্লিষ্টতা নেই।

বিবৃতি নেওয়া ওই ব্যক্তি নিশ্চিত করেছেন, যে ব্যক্তি বিবৃতি দিয়েছেন, সুখরঞ্জন বালীর আসল ছবির সঙ্গে তার সম্পূর্ণ মিল রয়েছে।

বিবৃতি নেওয়া ওই ব্যক্তি বলেন, ‘সুখরঞ্জন বালী পুরো ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যা দেন। আমি মনে করি, ঘটনাটি সত্য না হলে এ রকম মুহুর্তে তার কাছ থেকে এমন বিবরণ আসা খুবই কঠিন।’ অবশ্য বালীকে তখন নার্ভাস দেখাচ্ছিল বলেও ওই ব্যক্তি নিউ এইজ-কে জানান।

বিবৃতিতে সুখরঞ্জন বালী বলেছেন, ওই অফিসের লোকজন পুলিশের পোশাক পরিহিত ছিল । আমাকে যখন তারা অপহরণ করেছিল তখন সাদা পোশাকে ছিল।

অফিসে তাকে কোনো ধরনের নির্যাতন করা হয়নি বলে তিনি জানান। তবে ‘কেন আমি সাঈদী সাহেবের পক্ষে এজন্য প্রশ্ন করা হয়েছিল… তারা বলেছেন- আমাকে হত্যা করা হবে এবং সাঈদী সাহেবকে ফাঁসিতে ঝুলানো হবে।’

বিবৃতি অনুযায়ী, গত ২০১২ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে হস্তান্তরের আগে ঢাকায় তাকে ৬ সপ্তাহ ধরে অবৈধভাবে আটক করে রাখা হয়।

নিউ এইজ নিরপেক্ষভাবে সুখরঞ্জন বালী’র এসব দাবি নিশ্চিত করতে পারেনি। কারণ, এর আগে তার পরিবার এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আসামিপক্ষের দেওয়া বক্তব্যে গরমিল রয়েছে।

গত ৩ এপ্রিল ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে দেশটির ফরেনার অ্যাক্ট-১৯৪৬ এর অধীনে কলকাতার একটি আদালত বালীকে ১০৫ দিনের কারাদন্ড দেন। যেহেতু বিচার চলাকালে এ সময়টা তিনি কারাভোগ করেছেন, সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তাকে যেকোনো দিন বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হতে পারে।

নিউ এজ-এর প্রতিবেদক ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া এবং পাবলিক রিলেশনস কর্মকর্তা মো. মাসুদুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে (সুখরঞ্জন বালীর বিষয়ে) কোনো তথ্য নেই। আমি যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলামের (পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা) সঙ্গে কথা বলেছি এবং তিনি বলেছেন- তিনি কিছুই জানেন না। এই মুহূর্তে বালী কোথায় আছে তিনি তা জানেন না।’

গত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় দুটি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মাওলানা সাঈদীকে মৃত্যুদন্ড দেন। এরমধ্যে একটি হলো- সুখরঞ্জন বালীর ভাই বিশা বালীকে হত্যায় জড়িত থাকা।

আদালত রায়ে উল্লেখ করেন, বিশা বালীকে একটি নারকেল গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছিল এবং ‘অভিযুক্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর উস্কানিতে রাজাকার বাহিনীর গুলিতে তিনি নিহত হন।’ আদালত অন্য ছয়টি অপরাধের জন্য তাকে দোষী সাব্যস্ত করলেও কোনো সাজা ঘোষণা করেননি। মামলাটি বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে রয়েছে।

ট্রাইব্যুনাল চত্বর থেকে সুখরঞ্জন বালীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপহরণ করেছে এমন অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে সরকার এবং ট্রাইব্যুনাল কর্তৃপক্ষ।

গত বছরের ৫ নভেম্বর আসামিপক্ষের আইনজীবীরা ঘটনাটি তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জানালে চিফ প্রসিকিউটর আদালতকে বলেন, ‘আদালত চত্বরে থাকা পুলিশ কর্মকর্তারা তাদের জানা মতে এমন কিছু হয়নি বলে জানিয়েছেন।’ প্রধান চিফ প্রসিকিউটরের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করে তদন্ত সংস্থা ।

এরই ধারাবাহিকতায় ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এই অপহরণের অভিযোগ নেতাদের বেআইনিভাবে মুক্ত করতে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টায় তাদের (জামায়াতে ইসলামীর) অগ্রহণযোগ্য নাটকের অংশ।’

অপহরণের ঘটনার এক সপ্তাহ পর হেবিয়াস কার্পাসের এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘এ গল্প একেবারেই ভিত্তিহীন… এই আবেদন একবারেই বিভ্রান্তিকর।’

সুখরঞ্জন বালীর বিবৃতিতে বলা হয়, ৬ সপ্তাহ তাকে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আটকে রাখার পর ২৩ ডিসেম্বর তার চোখ বেঁধে ফেলা হয়। বাংলাদেশ পুলিশ তাকে সীমান্তে নিয়ে যায় এবং ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফের হাতে তাকে দেয়।

নিজের সই করা বিবৃতিতে সুখরঞ্জন বালী বলেন, ‘তারা আমাকে খাবার খাওয়াতে মাগুরার একটি হোটেলের সামনে গাড়ি থামায়। তারা আমার চোখের বাঁধন খুলে দেয় এবং আমি বুঝতে পারি আমাকে প্রাইভেটকারে এখানে আনা হয়েছে।’

সুখরঞ্জন বালী বলেন, ‘আমার খাবার গ্রহণ শেষ হলে ফের আমার চোখ বেঁধে ফেলা হয় এবং আমাদের গাড়ি ফের চলতে শুরু করে। সর্বশেষ বিকেল ৫টার দিকে বিএসএফের হাতে আমাকে তুলে দিয়ে তারা চলে যায়।’

সুখরঞ্জন বালী বলেন, ‘বিএসএফ সদস্যরা তার সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করে। তারা আমাকে নির্যাতন করে এবং জানতে চায় আমি সেখানে কী করছিলাম। বিএসএফের হাতে তুলে দেওয়ার আগ পর্যন্ত আমি কী করেছি তা তুলে ধরার চেষ্টা করি। সম্ভবতঃ তারা আমার কাছ থেকে সন্তোষজনক জবাব পায়নি এবং আমাকে বেধড়ক মারধর করা হয়।’

এতে আহত হলে বিএসএফ তাকে একটি হাসপাতালে নিয়ে যায় এবং সেখান থেকে স্বরূপনগর থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে পরদিন তাকে বসিরহাট আদালতে তোলা হয়। বসিরহাট কারাগারে ২০ দিন আটক থাকার পর তাকে দম দম সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানো হয় বলে জানান সুখরঞ্জন বালী।

ভারতীয় পুলিশের ২০১২ সালের ২৪ ডিসেম্বর দাখিল করা প্রথম প্রতিবেদনে বলা হয়, পুলিশ কর্মকর্তা কুলদীপ সিং ভারতীয় সীমান্তবর্তী স্বরূপনগরে ‘সন্দেহজনক গতিবিধি পর্যবেক্ষণ’ করেন এবং সুখরঞ্জন বালীকে চ্যালেঞ্জ করলে তিনি পালান। এফআইআর-এ বলা হয়, আটক করা হলে বালী তাদের জানান, ‘তিনি বাংলাদেশ থেকে তার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ