জন্মের আগেই চাকরিতে ওসি!
রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, মাদারীপুরঃ চাকুরিতে যোগদানের সময় কাগজপত্রে তার জন্ম সাল ছিল ১৯৫৫। কিন্তু পুলিশের খতিয়ান বইতে লেখা আছে ১৯৫৯ এবং বাংলাদেশ পুলিশ (বিপি) নম্বরেও তিনি বর্তমানে তার জন্ম সাল ব্যবহার করছেন ৫৯। এই অনুযায়ী ১৯৭১ সালে তার বয়স ১২ হলেও ২০১০ সালে প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা সনদ দিয়ে চলতি বছরের এপ্রিল মাসে এক বছর চাকুরির মেয়াদও বৃদ্ধি করেছেন। আবার ১৯৯৫ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের কাগজপত্রে জন্ম সাল ব্যবহার করেছেন ১৯৭৮। অথচ পুলিশে চাকুরি নিয়েছেন ১৯৭৭ সালে অর্থাৎ জন্মের এক বছর আগে। এমনই বিভিন্ন কাগজপত্রে বিভিন্ন জন্ম তারিখ ও সাল ব্যবহার করে চরম বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন পুলিশের এক পরিদর্শক।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দফতরের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৭ সালে ফরিদপুর জেলায় কনস্টেবল পদে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন জেলার ভাঙ্গা থানার ডা. আব্দুল গণি খানের ছেলে একেএম মাসুদ খান। পুলিশ ভেরিফিকেশন রোলে তার জন্ম তারিখ ৩১-০৩-১৯৫৫ এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা দশম শ্রেণী স্পষ্টভাবে লেখা ছিল। তিনি সিআইডি ঢাকায় কর্মরত থাকাকালে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ১৯৯৫ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে উত্তীর্ণ হন। ওই এসএসসি পরীক্ষার সনদপত্রে তার জন্ম তারিখ ১৩-০৩-১৯৭৮। অর্থাৎ ১৯৭৭ সালে পুলিশে চাকুরি নেওয়া কোনো ব্যক্তির জন্ম তার চাকুরিতে যোগদানের এক বছর পরে।
এই এসএসসি পাশের জন্ম তারিখ নিয়েই জটিলতা শুধু নয়। পুলিশ পরিদর্শক (ওসি) একেএম মাসুদ খানের চাকুরির খতিয়ান বইতে তার জন্ম তারিখ ঘষামাজা ও একাধিকবার কাটাকাটি করে লেখা হয় ১৩-০৩-১৯৫৯। বিষয়টি নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হলে পুলিশ হেডকোয়ার্টাসের ‘জিএ/৫৫-২০০৫ (অংশ-৩) (ইন্স)/১৬১৩’ স্মারক অনুযায়ী তদন্ত হয়। ২০১১ সালে মুন্সীগঞ্জ জেলায় চাকুরিরত থাকা অবস্থায় তার অবসর গ্রহণের তারিখ নির্ধারণ নিয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টাসের এআইজি (সংস্থাপন) মো. আমিনুল ইসলাম তদন্ত করে মতামত প্রদান করেন যে, ‘বিষয়টি অভিনব’।
পুলিশ পরিদর্শক একেএম মাসুদ খান বর্তমানে মাদারীপুরের শিবচর থানায় অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হিসেবে কর্মরত আছেন। ২০১১ সালে তার জন্ম তারিখ নিয়ে যখন তদন্ত হয়, তখনই ২২-০৫-২০১১ তারিখে ২৯৮০নং গেজেটে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভূক্ত হন একেএম মাসুদ খান। তার সনদ নম্বর ম-১৪৬৮৪৬, স্মারক নং- ২৯৩২, তারিখ ১৪-০২-২০১০। এরপর ২০১৩ সালের ১০ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন পুলিশ পরিদর্শক একেএম মাসুদ খান। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) মন্তব্য সহকারে গত ২৪ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রত্যয়ন করে। এই প্রত্যয়নের ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ২৫ মার্চ পুলিশ মহাপরিদর্শক বরাবর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়। তার এলপিআর-এ যাওয়ার তারিখ ৩০-০৩-২০১৪ এর তিন দিন পর এআইজি (সংস্থাপন) থেকে মাদারীপুর পুলিশ সুপারের কাছে তার চাকুরির মেয়াদ বৃদ্ধি সংক্রান্ত নির্দেশনা এসে পৌছে।
কাগজপত্রের সবচেয়ে বিভ্রান্তিকর যে বিষয়টি লক্ষ্যণীয় তা হলো, পুলিশ পরিদর্শক (ওসি) একেএম মাসুদ খানের চাকুরির খতিয়ান বইতে তার জন্ম তারিখ ঘষামাজা ও কাটাকাটি করে লেখা রয়েছে ৩১-০৩-১৯৫৯। এছাড়া তিনি বর্তমানে পুলিশ কর্মকর্তা সনাক্তকরণ নম্বর অর্থাৎ বিপি নম্বর ব্যবহার করছেন ৫৯৭৭০১০৪৯৮। তার স্বাক্ষরিত মামলা ও অন্যান্য কাগজপত্রে সীলমোহরে বর্তমানে তার এই বিপি নম্বর স্পষ্টভাবেই রয়েছে। এই বিপি নম্বরের প্রথম দুই সংখ্যা জন্ম সাল নির্দেশ করায় তিনি ১৯৫৯ সালকে তার জন্ম তারিখ হিসেবেই মেনে নিয়ে বিপি নম্বরে ব্যবহার করছেন।
অথচ তিনি ১৯৭১ সালে ভাঙ্গা-ফরিদপুর অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন বলে তিনি ২০১০ সালে সার্টিফিকেট প্রাপ্ত হন। কিন্তু ’৫৯ সালে তার জন্ম হলে মুক্তিযুদ্ধের সময় অর্থাৎ ৭১ সালে তার বয়স হয় ১২ বছর। তা হলে সম্ভবত তিনিই হবেন দেশের সর্বকনিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা!
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত না হওয়ায়, ইতোপূর্বে চাকুরিরত অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেকে ঘোষণা না দেওয়ায় এবং তার তিনটি জন্ম তারিখ নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ায় একেএম মাসুদ খানের মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে পুনরায় গোয়েন্দা সংস্থা ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তদন্ত শুরু করেছে। পুলিশের মহাপরিদর্শকের সামনে হাজির হয়ে তার চাকুরির পূর্ণাঙ্গ বিবরণসহ বক্তব্য পেশ করার জন্য নির্দেশও প্রদান করা হয়েছে।
এ বিষয়ে শিবচর থানার (ওসি) একেএম মাসুদ খান বলেন, ‘এসএসসি’র কাগজে জন্ম তারিখ ভুল ছিল। এগুলো নিয়ে অনেক কিছু হয়েছে। পুলিশ খতিয়ান বইতে ঘষামাজার বিষয়টি আমি জানি না, এটা কেউ শত্রুতা করে করেছে। সেখানে জন্ম তারিখ ও বিপি নম্বর ভুল ছিল ৫৯, এখন তা ৫৫ করা হয়েছে। এখন আমার সব কাগজপত্রে জন্ম সাল ১৯৫৫।’
দীর্ঘ দিন ধরে আপনার সিল-এ বিপি নম্বর ৫৯ অর্থাৎ জন্ম সাল ৫৯ স্বীকার করে আপনি বিপি নম্বর ব্যবহার করেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এগুলো নিয়ে খোঁচাখুঁচি করে লাভ নেই। এই জন্য আমাকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহি করতে হয়েছে। আমি পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে অর্ডার করিয়ে এনেছি। অফিসিয়াল সিক্রেসি অনুযায়ী এগুলোতো আপনি জানতে পারেন না।’
মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্রে আপনার জন্ম তারিখ বা বয়স কত ছিল এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল ১৬, আমি স্কুলছাত্র ছিলাম এবং পরীক্ষা দিয়েছিলাম।’
কোন স্কুলে পড়েছেন ও কোথায় যুদ্ধ করেছেন এই প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘এই বিষয় আমি আপনার কাছে বলব না। আমি দেশের বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধ করেছি, অনেক জায়গায় ছিলাম।’
এদিকে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভাঙ্গার এক মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘মাসুদকে আমরা কখনও যুদ্ধ করতে দেখি নাই। তার সনদ পাওয়ার বিষয়টি রহস্যজনক।’
তবে ভাঙ্গা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডর আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় মাসুদ খান আমাদের ইয়াং সোর্স ছিলো।’