দেশ আতংকের জনপদে পরিণত হয়েছে : ফখরুল
সিনিয়র রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ বাংলাদেশ মৃত্যু উপত্যকা বা আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি বলেন, ‘নির্বিচারে হত্যা, আতংক, উৎপীড়ন থেকে মুক্তির জন্য, জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে স্বাধীনভাবে মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার জন্য আমরা জীবনবাজী রেখে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। আমরা স্বাধীন দেশে একটি ন্যায় বিচারভিত্তিক গণতান্ত্রিক সভ্য সমাজের জন্য লড়াই করেছি। আমাদের সকল অর্জন আজ ভুলুন্ঠিত হয়েছে।’
শুক্রবার বিকেলে চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে দেশের চলমান রাজনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সার্বিক চিত্র তুলে ধরতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।
সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘দেশে যে কী চরম অস্বাভাবিক অবস্থা, কী ভয়াবহ নৈরাজ্য চলছে তা আপনারা সকলেই জানেন। জনগণের ভোটছাড়াই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বর্তমান সরকারের আমলে সমগ্র বাংলাদেশ আজ এক ত্রাসের রাজত্বে পরিণত হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সরকারের অত্যাচার, নিপীড়ন, জেল-জুলুম, হামলা-মামলা, বিচার-বহির্ভূত হত্যাকা- ও দমন অভিযানের পাশাপাশি অপহরণ, গুম, খুন আজ এক নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা ছাড়াও এখন ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, জনপ্রতিনিধি, আইনজীবীরাও অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন। নারী ও শিশু-কিশোররাও রেহাই পাচ্ছে না।’
ফখরুল বলেন, ‘দল-মত নির্বিশেষে নাগরিকেরা, দল-নিরপেক্ষ মানুষেরা এবং সকল শ্রেণী-পেশা-ধর্মের জনসধারণ আজ আতঙ্কিত। কোথাও কারো কোনো নিরাপত্তা নেই। নদী-নালায়, খালে-বিলে, ডোবায়-জঙ্গলে, রাস্তায় লাশ পাওয়া যাচ্ছে। অনেক বেওয়ারিশ লাশের পরিচয়ও মিলছে না।’
দেশে আবারও ১৯৭৪-৭৫ সালের মতো হত্যা, গুম, আতংক ও উৎপীড়নের ভয়াবহ পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি ঘটছে উল্লেখ করে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘আজ মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নেই। অপহৃত নাগরিকের লাশটা পর্যন্ত স্বজনরা পাবে কিনা এবং ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী সেই লাশের সৎকারের নিশ্চয়তাটুকুও আজ আর নেই।’
তিনি বলেন, ‘জনগণের জানমাল, ইজ্জত-আব্রুর নিরাপত্তা বিধান করা সরকারের প্রধান কর্তব্য। সেই জননিরাপত্তাই যখন ভেঙ্গে পড়ে তখন দেশে কোনো সরকার আছে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। আজ দেশে যখন এক ভয়ংকর আতঙ্কের অবস্থা বিরাজ করছে তখন সরকার ‘আইন-শৃঙ্খলা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক’ বলে দাবি করে নাগরিকদের নিরাপত্তা ও আতংক নিয়ে চরম পরিহাস করে চলেছে।’
মির্জা আলমগীর বলেন, ‘দায়িত্বশীল কেউ কেউ বিরোধী দলকে দায়ী করে চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিচ্ছেন। মানুষের জীবন ও নিরাপত্তা নিয়ে এমন নিষ্ঠুর তামাশা ও রাজনৈতিক চাতুরি না করার জন্য আমি তাদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ-র্যাবসহ যে সকল বাহিনী আছে গণবিচ্ছিন্ন সরকার তাদের গদি রক্ষা ও বিরোধী দল দমনে চরম অনৈতিক ও বেআইনিভাবে ব্যবহার করে চলেছে। জনগণের এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয় স্বার্থে এমন অপব্যবহারের কারণে তাদের নৈতিক শক্তি, শৃঙ্খলা ও কার্যকারিতা ব্যাপকভাবে খর্ব হয়েছে। অপহরণ, গুম ও খুনের যে ব্যাপক মহামারী দেখা দিয়েছে তা রোধে এসব বাহিনী সাফল্যের পরিচয় দিতে পারছে না। কোথাও কোথাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসব ঘটনার সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেই দায় এড়াতে চাইছে শুধু।’
ফখরুল বলেন, ‘এই অস্বাভাবিক ও নৈরাজ্যকর অবস্থায় জনগণের দল হিসাবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকতে পারেনা। কারণ আজ কেবল বিএনপি, ১৯ দলীয় জোট এবং আমাদের নেতাকর্মী ও সমর্থকরাই নন, সারা দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা পুরোপুরি বিপন্ন হয়ে পড়েছে। সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জে সাত জনের অপহরণ সাত দিন পর শীতলক্ষ্যায় তাদের লাশ পাওয়া জনমনে প্রচণ্ড নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করেছে।’
সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন, এই পটভূমিতে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া মহান মে দিবসে ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল শ্রমিক জনসভার ভাষণে সারাদেশে সাংগঠনিক ‘রেড এলার্ট’ বা সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থা জারী করেছেন। তার এই সময়োপযোগী ঘোষণাকে আমরা স্বাগত জানাই। মানুষের জীবনের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য আমরা তাকে অভিনন্দন জানাই। জনগণের নিরাপত্তার দাবিতে তিনি নিজেও পথে নামার যে ঘোষণা দিয়েছেন, আমরা তার জন্যও ধন্যবাদ জানাই। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাংগঠনিক সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থা কার্যকর করার জন্য আমরা সারা দেশে বিএনপি এবং এর সকল অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের প্রতিটি স্তরের ও শাখার নেতা-কর্মীদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।’
এ সময় মির্জা ফখরুল দলীয় নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকতে ১০টি পরামর্শ দেন। পরামর্শগুলো হচ্ছে:
প্রত্যেকের আওতাধীন এলাকায় লিফলেট, পোস্টার, সভা, মতবিনিময়সহ বিভিন্ন পন্থায় অপহরণ-গুম হত্যা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন এবং এসব অপরাধের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলুন।
চলাফেরায় সতর্ক থাকুন। একা চলাচল এবং নির্জন ও অনিরাপদ স্থানগুলো এড়িয়ে চলুন।
নেতারা কর্মীদের, কর্মীরা নেতাদের এবং সকলে মিলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার দিকে খেয়াল রাখুন। যতদূর সম্ভব পারষ্পরিক যোগাযোগ বজায় রেখে চলুন।
প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর স্থানীয় কর্মকর্তাদের ফোন নম্বর ও যোগাযোগের ঠিকানা সংগ্রহে রাখুন। কোনো ঘটনা ঘটলে দ্রুত তাদেরকে জানান। দলের নেতাকর্মীদেরও ফোনে বা এসএমএস-এর মাধ্যমে জানিয়ে দিন।
বিএনপির সদর দফতরের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন। প্রতিটি ঘটনার রিপোর্ট কেন্দ্রকে জানান।
কোথাও অপহরণের উদ্যোগের সংবাদ পেলে যত বেশি সংখ্যক লোক মিলে দ্রুত সেখানে উপস্থিত হোন। মিলিতভাবে প্রতিরোধের চেষ্টা করুন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে কাউকে আটক করে নিয়ে যাবার চেষ্টা হলে তাদের পরিচয় সম্পর্কে এবং আটক ব্যক্তিকে কোথায় নেয়া হচ্ছে, সে সম্পর্কে নিশ্চিত হোন। আটক ব্যক্তিকে যেখানে নেয়া হচ্ছে সেখানে সদল বলে গিয়ে দায়িত্বশীলদের সঙ্গে কথা বলুন এবং কি অভিযোগে এবং কোন মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে তা জানার চেষ্টা করুন। কবে তাকে আদালতে সোপর্দ করা হবে তা-ও জেনে নিন। পারলে সাংবাদিক ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে নিন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভুয়া পরিচয় দিলে তাদেরকে প্রতিরোধ করুন। পুলিশে খবর দিয়ে তাদেরকে পুলিশের হাতে তুলে দিন। ভিকটিম পরিবারের পাশে দাঁড়ান। তাদের বিবরণ সংবাদ মাধ্যমে তুলে ধরুন। গুম, অপহরণ, খুনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-কর্মসূচি স্থানীয় ভিত্তিতে গ্রহণ ও পালন করুন। অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠনকে এই প্রতিবাদ আন্দোলনে সম্পৃক্ত করুন।
সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমরা মানুষের নিরাপত্তার জন্য দলীয় এই সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থার পাশাপাশি সমগ্র দেশবাসীর সক্রিয় সহযোগিতা চাই। প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য তাদের প্রতি আহ্বান জানাই। আমরা একটি নিরাপদ, সভ্য, গণতান্ত্রিক সমাজ চাই। এর জন্য আসুন, আমরা ঐক্যবদ্ধ হই, আমরা সোচ্চার হই।’
সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, ড. আর এ গণি, ব্যারিস্টার জমির উদ্দীন সরকার, এম কে আনোয়ার, বেগম সারোয়ারি রহমান, ড. আব্দুল মঈন খান, মির্জা আব্বাস, ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান, সাদেক হোসেন খোকা, হাফিজ উদ্দীন আহমেদ, বেগম সেলিমা রহমান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু, যুগ্ম-মহাসচিব মিজানুর রহমান মিনু ও ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন প্রমুখ।