৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদ বিলীন মাত্র চার বছরে
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) গঠিত টাস্ক ফোর্স কমিটির ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বেচ্ছাচারিতা ও নীতি বহির্ভূত কার্যক্রমে গত চার বছরে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে কমপক্ষে পাঁচ হাজার কোটি টাকার সম্পদ। ভাঙনরোধের কাজে গতি না থাকায় বছরের পর বছর ঝুলে রয়েছে হাজার কোটি টাকার বেশ কয়েকটি প্রকল্প।
সময়মতো ওই কমিটির নির্দেশনা না পাওয়ায় অধিকাংশ প্রকল্পের কাজই শুষ্ক মৌসুমে শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না। শুষ্ক মৌসুমের শেষ পর্যায়ে কাজের অনুমতি মিললেও যেটুকু কাজ হয় বর্ষায় তার চেয়েও বেশি ভেঙে পড়ে। একইসঙ্গে সময় উপযোগী পদক্ষেপ না নেওয়ায় হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন এলাকায় নির্মিত হার্ডপয়েন্ট, স্পার, গ্রোয়েন ভাঙনের কবলে পড়ছে। এছাড়া ভাঙনকবলিত এলাকাগুলোতে মানুষের বসতবাড়ী, আবাদি জমি, সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা, হাট-বাজার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রেলস্টেশন, হাসপাতাল, ব্রিজ ও কালভার্ট ইত্যাদি নদী ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না।
কমিটির আহ্বায়ক কাজী তোফায়েল আহমেদের ওপর পানি সম্পদ মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেনের আর্শীবাদ থাকায় এতকিছুর পরও কমিটির বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। এ নিয়ে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে পাউবো’র সর্বত্র ক্ষোভের আগুন জ্বলছে। এমতাবস্থায় দেশের সর্বোচ্চ আদালত এই কমিটির ওপর এক মাসের স্থগিতাদেশ দিয়েছেন। একইসাথে কেন এই কমিটিকে অবৈধ ঘোষণা করা হবে না- সে ব্যপারেও আদালত পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পাউবো’কে ২১ দিনের মধ্যে কারণ দর্শাতে বলেছে। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের মাননীয় বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি জাফর আহম্মেদ এর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ গত সপ্তাহে এই নির্দেশনা দিয়েছেন। এই নির্দেশনার কপি পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডেও পৌঁছেছে।
দ্রুততম সময়ের মধ্যে পাউবো’র প্রকল্পগুলোয় দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধ করে স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করার লক্ষ্যে এই টাস্ক ফোর্স গঠিত হলেও বর্তমানে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে এই কমিটি। পাউবো’র নির্বাহী প্রকৌশলী কাজী তোফায়েল আহমেদকে আহ্বায়ক করে এই টাস্ক ফোর্স কমিটি গঠন করা হয়। তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব এড়িয়ে অধিকাংশ সময়ই তিনি বদলি বাণিজ্য ও বিদেশ ভ্রমণ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
টাস্ক ফোর্স কমিটির কারণে নদী ভাঙনকবলিত মানুষের মাঝে ক্ষোভের আগুন জ্বলছে। স্থানীয় সংসদ সদস্যরাও এই কমিটির কার্যক্রম নিয়ে নানাভাবে প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্ত পানি সম্পদ মন্ত্রীর প্রিয়ভাজন হওয়্রা কারণে কমিটির আহ্বায়কের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগই গৃহিত হয় না। এমনকি গত ২৫ এপ্রিল পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির বৈঠকেও টাস্ক ফোর্স কমিটির স্বেচ্ছাচারিতা ও নিয়ম বহির্ভূত কর্মকাণ্ডের বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানেও কমিটির ব্যপারে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। অন্যদিকে, গ্রাম-বাংলার নদী ভাঙ্গনকবলিত মানুষও টাস্কফোর্স কমিটির কার্যক্রমে ফুঁসে উঠেছে। যথাসময়ে কাজের অনুমতি না দেওয়ায় বিভিন্ন সময়ে কমিটির আহ্বায়ক সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, চাপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, ভোলা, চাঁদপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় লাঞ্ছিতও হয়েছেন।
জানা যায়, টাস্ক ফোর্স কমিটির কারণে এই শুষ্ক মৌসুমেও জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, চাপাইনবাবগঞ্জ, ভোলা, চাঁদপুর, বরগুনাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় নদী তীর সংরক্ষণের কাজ করা সম্ভব হয়নি।
টাস্ক ফোর্স কমিটির বিরুদ্ধে অসংখ্য লিখিত অভিযোগ পড়েছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডে। এসব অভিযোগের কোনটিই আমলে নেওয়া হয় না। কমিটি তার কর্মকাণ্ডের জন্য পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব, পাউবো’র মহাপরিচালক থেকে শুরু করে উর্ধ্বতন কোন কর্মকতার কাছেই জবাবদিহি করে না। ফলে কমিটির আহ্বায়কের একক স্বেচ্ছাচারিতার কবলে বন্দী পানি উন্নয়ন বোর্ডের সকল প্রকল্পের ভাগ্য।
এমন পরিস্থিতির কারণে চলতি বর্ষায় দেশের বিভিন্ন এলাকা ব্যাপকভাবে নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়বে। কারণ, কমিটির অনুমতি ছাড়া দেশের কোন এলাকাতেই নদী তীর সংরক্ষণের কাজে ব্লক কার্পেটিং ও ব্লক ডাম্পিং, জিও ব্যাগ কার্পেটিং ও ডাম্পিংয়ের কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। পাউবো মহাপরিচালক, অতিরিক্ত মহাপরিচালক, প্রধান প্রকৌশলী কারও পক্ষেই টাস্ক ফোর্স কমিটিকে এড়িয়ে কোন নির্দেশনা প্রদান করাও সম্ভব নয়। টাস্ক ফোর্স কমিটিকে এড়িয়ে কোন নির্দেশনা দেওয়া হলে সেই কাজের বিল আটকে যাবে মন্ত্রীর নির্দেশে।
বর্তমানে পাউবো’র এমন বেহাল দশায় ক্ষোভের সাথেই হাইকোর্টে রিট দায়েরকারি ঠিকাদার হায়দার আলী বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কতিপয় ব্যক্তির স্বার্থে গড়ে তোলা টাস্ক ফোর্স কমিটি এখন গোটা পাউবো’র জন্য এক দানবে পরিণত হয়েছে। টাস্ক ফোর্স কমিটির কারণে গত চার বছরেই কমপক্ষে ৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
জানা যায়, টাস্ক কমিটির আহ্বায়ক শুধুমাত্র দুই মাসের মধ্যেই দু’বার বিদেশ সফর করে এসেছেন। আর গত দুই বছরে তিনি আমেরিকা, নেদারল্যন্ড, চীনসহ সাতটি দেশ সফর করেছেন। তার এই সফরের সমালোচনা করে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সকল প্রকল্পের কাজ যখন তোফায়েলের নির্দেশের অপেক্ষায় আটকে আছে; মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা যখন নদী তীর সংরক্ষণে ব্লক কিম্বা জিও ব্যাগ কার্পেটিং কিম্বা ডাম্পিংয়ের অনুমতির জন্য চাতক পাখির মত চেয়ে আছেন তখন কমিটির আহ্বায়ক ঘুরে বেড়াচ্ছেন এক দেশ থেকে আরেক দেশ।
অভিযোগ রয়েছে, সিরাজগঞ্জ হার্ড পয়েন্টে ভাঙ্গনের জন্য এই কমিটির কার্যক্রমই দায়ী ছিল। এই কমিটির গাফিলতির কারণে যথাসময়ে নদীতে ব্লক ডাম্পিংয়ের কাজ শুরু করা যায়নি। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত তোফয়েল আহমদের কাছে নদীতে ব্লক নিক্ষেপের অনুমতি চাওয়া হলে তিনি এই অনুমতি দেননি। ওই সময় প্রতিমাসে ২ থেকে আড়াই লাখ ব্লক নির্মাণ করা হচ্ছিল। পর্যাপ্ত ব্লক থাকার পরও শুষ্ক মৌসুমে কাজ শুরু করতে না পারায় সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীরও ক্ষোভ বাড়ছিল। এ নিয়ে পানি সম্পদ মন্ত্রী, পাউবো মহাপরিচালক এবং ওই সময়কার নির্বাহী প্রকৌশলীর পক্ষ থেকে কমিটির কাছে দ্রুত ব্লক ডাম্পিংয়ের অনুমতি চাওয়া হয়। কিন্ত কমিটি এটি আমলে না নিয়ে কাজ শুরুর নির্দেশনা দেন বর্ষার শুরুতে মে মাসে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বর্ষায় নদী তীর সংরক্ষণ কাজ করা যাবে না- পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের এমন নির্দেশনা থাকলেও সিরাজগঞ্জ হার্ড পয়েন্টে ব্লক ডাম্পিংয়ের অনুমতি দেওয়া হয় এই বর্ষা মৌসুমেই। আর বর্ষায় ডাম্পিং শুরু করার কারণে সিরাজগঞ্জ হার্ডপয়েন্ট তিন দফা ভাঙ্গনের কবলে পড়ে। এ নিয়ে সেখানে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দেয়। ভাঙচুর হয় স্থানীয় পাউবো অফিস এবং লাঞ্ছিত হয় পাউবো’র বেশ ক’জন কর্মকর্তা। আর অপচয় হয় সরকারের শত শত কোটি টাকা। একইভাবে, কমিটির খবরদারির কারণে বগুড়ায় দরপত্র সম্পন্ন করেও শেষ পর্যন্ত কাজ হয়নি। ঠিকাদাররা বিড ফেরত নিয়েছে। এই কমিটির কারণে জামালপুরে হার্ডপয়েন্ট, রেলস্টেশন, মাদ্রাসাসহ অসংখ্য স্থাপনা নদীগর্ভে চলে গেছে। জামালপুরে পিংনা বাজারে ব্লক কার্পেটিং ও ডাম্পিংয়ের অনুমতির জন্য সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টাস্ক ফোর্স কমিটির শুধুমাত্র পা ধরতে বাকি রেখেছেন। এরপরও ওই ঠিকাদারকে শুষ্ক মৌসুমে কাজ সম্পন্ন করার অনুমতি না দিয়ে কমিটির আহ্বায়ক বিদেশ সফরে চলে যান। ফলে এই বর্ষাতে ফুটানিবাজার থেকে পিংনা এলাকা পর্যন্ত ব্যাপকভাবে যমুনার ভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এমনিতেই তোফায়েল কমিটির স্বেচ্ছাচারিতার কারণে জামালপুরে ৩শ’ কোটি টাকার কাজ এক বছরে বেড়ে ৪১৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। আগামী বছর এই কাজের ব্যয় আরও বাড়বে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাউবো’র এক কর্মকর্তা জানান। এ ব্যপারে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম পাউবো-কে লিখিতভাবে জানিয়েছেন, ‘যমুনা নদীর ভাঙ্গন হতে জামালপুর জেলার বাহাদুরাবাদ ঘাট হতে ফুটানিবাজার পর্যন্ত এবং সরিষাবাড়ী উপজেলাধীন পিংনা বাজার এলাকা হতে ইসলামপুর উপজেলার হারগিলা পর্যন্ত নদী তীর সংরক্ষণ’ প্রকল্প কাজ বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এই কাজ সম্পন্ন করা অত্যাবশ্যক। কিন্ত টাস্ক ফোর্স কমিটির অনুমতি না মেলায় তা সম্ভব হচ্ছে না। এভাবেই তোফায়েল কমিটির স্বেচ্ছাচারিতার কাছে কুষ্টিয়া, পাবনা, বগুড়া, বরিশাল, ভোলা, বড়গুনা জামালপুর, সিলেট, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগজ্ঞ, কুমিল্লাসহ অনেক এলাকার নদী তীর সংরক্ষণের কাজ আটকে রয়েছে।
এ ব্যপারে জানতে চাইলে তিনি এবিসিনিউজবিডিকে বলেন টাস্ক ফোর্স কমিটির আহ্বায়ক কাজী তোফায়েল আহমেদ মুঠোফোনে বলেন, কমিটি তার কাজের জন্য কারও কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়। আমাকে মন্ত্রীই এই পদে রেখেছেন। তিনি যেভাবে বলেন আমি সেভাবেই কাজ করছি। আদালতের নির্দেশনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আদালত কোন নির্দেশনা দিয়ে থাকলে সেটি পাউবো’র দেখার দায়িত্ব। টাস্ক ফোর্স কমিটির গাফিলতি, স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম, নীতিবহির্ভূত কার্যক্রম ও ক্ষমতার অপব্যবহার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবার মন জয় করেতো আর চলা সম্ভব নয়। মন্ত্রী আপনাকে কেন এতটা ‘ফেবার’ করেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, উনি (পানি সম্পদ মন্ত্রী) আমাকে ফেবার নয়; স্নেহ করেন। এ ব্যাপারে মুঠোফোনে পানি সম্পদ মন্ত্রী রমশে চন্দ্র সেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তার কোন প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।