জামায়াতের বিরুদ্ধে ফরমাল চার্জ ৮০ ভাগ প্রস্তুত

Jamaat-e-Islam-logo-new20130304102809একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযক্ত সংগঠন হিসেবে জামায়াত নিষিদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দাবিতে সংগঠনটিকে জরিমানা করার সুপারিশ নিয়ে প্রসিকিউশনের তুমুল প্রস্তুতি চলছে। চুড়ান্ত প্রস্তুতি শেষ করতে আরও সময় লাগতে পারে। তবে এই মাসেই অভিযোগ দাখিল করা হতে পারে বলেও জানা গেছে।
এ বিষয়ে মামলা পরিচালনা কমিটির প্রধান সমন্বয়ক প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ এবিসি নিউজ বিডিকে বলেন, ‘নথিপত্র যাচাই বাছাই এবং সংগঠন হিসেবে দলটির কর্মকাণ্ড পর্যালোচা জোর দিলেও এ পর্যন্ত ৮০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে, এখনও প্রায় ২০ ভাগ কাজ বাকী রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘প্রসিকিউশন টিমের সদস্যদের ভাগ করে দেওয়া দায়িত্ব ও সকল খুটিনাটি পর্যালোচনা পরে সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে মামলার বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি শেষ করা হবে।’
প্রসিকিউটর রিজিয়া সুলতানা চমন এবিসি নিউজ বিডিকে বলেন, ‘টিমের সকল সদস্য ঠিক মতো কাজ করতে পারছেন না। তার ওপর তুরিন আপা কিছুদিন ধরে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাই আমরা সকলে মিলে বসতেও পারছি না। টিমে সদস্যদের অন্যান্য মামলা থাকায় শুধুমাত্র তুরিন আপা একা জামায়াত নিয়ে কাজ করছেন। তাই সম্পূর্ণ প্রস্ততি শেষ হয়নি। তবে আমরা মে মাসেই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) গঠন করার জন্য সংগঠনের সামগ্রিক বিষয় পর্যবেক্ষন করছি।’
প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ বলেন, ‘খুব দ্রুত বা এই মাসের ১৫-১৬ তারিখের মধ্যে ফরমাল চার্জ দাখিল করা হচ্ছে না। তবে যথাসম্ভব মে মাসের মধ্যেই জামায়াতের অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করে বিচারের জন্য উপস্থাপন করা হবে।’
জামায়াতের মামলায় টিমের সমন্বয়ক তুরিন আফরোজ এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। তদন্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনে আসা থেকে জামায়াত নিয়ে স্ট্যাডি করতে করতেই তিনি এপ্রিলের শেষ দিকে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। কয়েক সপ্তাহ অসুস্থতা নিয়ে অফিস করেন। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ১৪ মে থেকে আবর পুরোদমে কাজ শুরু করবেন বলে জানান তিনি।
মামলা প্রস্তুতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের তালিকা ও লাইব্রেরিতে রাখা বই দেখিয়ে তুরিন আফরোজ এবিসি নিউজ বিডিকে বলেন, ‘মওদূদী, গোলাম আযম, নিজামীসহ জামায়াতের বিভিন্ন লেখেকের লেখা বইসহ প্রয়োজনীয় হাজার হাজার বই অধ্যায়ন করতে হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামও মামলায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তারপরও যদি কোনো তথ্যে ঘাটতি দেখা দেয় তাহলে মুক্তিযুদ্ধকালীণ চরমপত্রগুলো কাজে লাগবে।’
সবগুলি বই পাঠ করার পরে তা আন্ডার লাইন করা এবং নোট গ্রহণ করা চলছে। তাতে প্রসিকিউশ টিমের সদস্যসহ আগ্রহী অনেকেই সহযোগিতা করছেন বলে জানান ড. তুরিন আফরোজ। তবে তিনি ২৪ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে ব্যক্তিগত কাজ ছাড়া জামায়াতের মামলায় পর্যবেক্ষণ, বই পুস্তক নথি ঘেটেই সময় পার করছেন।
ক্রিমিনাল সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (ফরমাল চার্জ) মে মাসের মাঝামাঝি দাখিল করার চিন্তা থাকলেও পূর্ণ প্রস্তুতি শেষ না করে মে মাসের শেষের দিকে দাখিল করা হতে পারে।
তুরিন আফরোজ জানিয়েছেন, জামায়াতের মামলাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মামলার সব বিষয় খুঁটিনাটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ফরমাল চার্জ দাখিল করা হতে পারে ট্রাইব্যুনালে। যাতে কোনোরূপ ভুল ত্রুটি না পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, ‘এতদিন আমরা মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলায় লড়েছি। এখন সংগঠনের বিরুদ্ধে মামলায় লড়তে হচ্ছে। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল। ইতোমধ্যে তদন্ত সংস্থা থেকে চূড়ান্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর আমরা ওই রিপোর্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য প্রসিকিউশন টিমের সাতজনকে দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছি। এই মামলার টিম লিডার সমন্বয়ক করা হয়েছে আমাকে। আমরা সকলে বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনটা থাকবে এবং কি নতুন করে যোগ কতে হবে তা ঠিক করার পর চুড়ান্ত করা হবে মামলার এ টু জেট।’
টিমের অন্য প্রসিকিউটররা হলেন- রানা দাশগুপ্ত, জেয়াদ- আলু মালুম, একেএম সাইফুল ইসলাম, সুলতান মাহমুদ সিমন, ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল ও রেজিয়া সুলতানা চমন।
জামায়াতের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের বিষয়ে তুরিন আফরোজ বলেন, ‘তদন্ত শেষ হয়েছে। এ অভিযোগের উপর ভিত্তি করে সংগঠনটি নিষিদ্ধ হতে পারে, তবে তাদের সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে কিনা আামি নিশ্চিত না।’
তিনি বলেন, ‘তদন্তে প্রায় ১০৮টি প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে এসেছে কিন্তু তা নিষিদ্ধ করা হবে কিনা বা তার কার্যক্রম বন্ধ করা হবে কিনা সেটাও ভেবে দেখার বিষয়। কারণ এই প্রসেসিংটা জটিল। কারণ সংগঠনের কোনো ব্যাক্তি জড়িত থাকলেও গোটা কোনো প্রতিষ্ঠানই জামায়াতের একার প্রতিষ্ঠান নয়। তাই এক ব্যক্তির জন্য তো আর গোটা প্রতিষ্ঠান বাজেয়াপ্ত বা বন্ধ করা সম্ভব না। এটা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়।’
তুরিন আফরোজ বলেন, ‘বিধি অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবে না।’
তবে অন্য প্রসিকিউটর রানা দাশ গুপ্ত বলেছেন, ‘তদন্ত সংস্থা জামায়াতের বিরুদ্ধে যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে আমরা তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছি। ১০ হাজার পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট। যা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে সময়েরও প্রয়োজন। জামায়াতের মতো এত বড় একটি দলের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ মামলার বিষয়ে তাড়াহুড়ো করা ঠিক হবে না।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ফরমাল চার্জ দাখিলের জন্য সকলে মিলে কাজ করছি, সকলের সর্বাত্বক সহযোগিতায় মামলার প্রস্তুতি চলছে। জানা গেছে জামায়াতের মামলার বিষয়ে জানতে প্রসিকিউটর একেএম সাইফুল ইসলাম বিদেশে গেছেন। রানাদাস গুপ্ত ও সুলতান মাহমুদ সিমন নিজ নিজ মামলা পরিচালনার পাশাপাশি সহযোগিতা করছেন।’
গত ২৫ মার্চ তদন্ত সংস্থা জামায়াতের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। পরে প্রতিবেদনটি ২৭ মার্চ প্রসিকিউটর বরাবর হস্তান্তর করে। তদন্ত সংস্থা চূড়ান্ত রিপোর্টে জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধের সুপারিশের পাশাপাশি তাদের আর্থিক ১০৮টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণেরও সুপারিশ করেছে।
তদন্ত রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, একাত্তরে জামায়াতে ইসলামী সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে। পাকিস্তানিদের সহায়তায় জামায়াত নেতাকর্মীদের রাজাকার, আলবদর, আলশামস এ নিয়োগ করা হয়। এসব অভিযোগে এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতসহ কয়েকটি দলের শীর্ষ নেতাদের বিচার চলছে।
তদন্ত সংস্থা চূড়ান্ত রিপোর্টে জামায়াতকে দল হিসেবে নিষিদ্ধের পাশাপাশি ইসলামী আদর্শ নিয়ে রাজনীতি নিষিদ্ধের সুপারিশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে জামায়াত তাদের সহযোগী সংগঠক ইসলামী ছাত্রসংঘ ও দলটির মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত দৈনিক সংগ্রাম নিষিদ্ধের আবেদন করেছে। সংগঠনটির সম্পদ বিলুপ্তিরও আবেদন করা হয়েছে। এই প্রথম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কোনো সংগঠনের বিরুদ্ধে বিচার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
মানবতাবিরাধী অপরাধে ইতিমধ্যে নয়টি মামলায় ১০ জনের বিচার শেষে রায় ঘোষণা করা হয়েছে ট্রাইব্যুনালে। মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন ধরনের দণ্ড ঘোষণা করা হয়েছে। এখন ক্রিমিনাল সংগঠন হিসেবে জামায়াতে বিরুদ্ধে বিচারের প্রস্তুতি চলছে। জামায়াতের অপরাধের সময়কাল একাত্তরে ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর। অপরাধের স্থান , বাংলাদেশের সর্বত্র।
১৯৪১ সালের এপ্রিল থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে মাওলানা মওদূদীর নেতৃত্বে জামায়াত ইসলামীর যাত্রা শুরু ভারতীয় উপমহাদেশে। পরে নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে জামায়াতের রাজনীতি অগ্রসর হয়েছে। এরই মধ্যে জামায়াতকে তিনবার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সম্প্রতি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে রায় প্রদান করেছেন।
অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক অপরাধ উভয় ট্রাইব্যুনালের বেশ কয়েকটি রায়ে জামায়াতে ইসলামীকে ক্রিমিনাল সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করে পর্যবেক্ষণ করেছেন।
এর পর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধের দাবি জানায়। ২০১৩ সালের ১৮ আগস্ট থেকে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে তদন্ত কর্মকর্তা মতিউর রহমান। এরপর আট মাস তদন্ত শেষে ২৫ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে তদন্ত সংস্থা।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ