জাতীয় পরিচয়পত্র সুরক্ষায় ব্যর্থ ইসি
সিনিয়র রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ জাতীয় নিরাপত্তা ও নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে দেশের সকল নাগরিককে জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। একই সঙ্গে এ পরিচয়পত্রের সুরক্ষার দায়িত্বও ছিল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের। কিন্তু ইসির চরম ব্যর্থতায় ভুঁয়া জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি হচ্ছে যত্রযত্র। এ কার্ডের অপব্যবহারে নাগরিকদের জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। আবার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হতে সেবা গ্রহণের সময় হয়রানির স্বীকারও হচ্ছেন সাধারণ নাগরিক। যদিও দুই বছর আগেই সরকারের অর্থ বিভাগকে চিঠি দিয়ে ইসি জানিয়েছিল, দেশের সব নাগরিককে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান করার পূর্বে এর ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা যাবে না। কিন্তু এখনও নির্বাচন কমিশনের এ নির্দেশনার বাস্তব কোনো প্রতিফলন নেই। বরং বর্তমান সময়ে দেখা যাচ্ছে কমিশনের নির্দেশ অমান্য করে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় পরিচয়পত্রের ব্যবহার দিন দিন বাধ্যতামূলক করছে। এতে সাধারণ মানুষ কেবল হয়রানির শিকার হচ্ছেন না বরং এতে জাতীয় নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে নাগরিক সেবা নিতে গিয়ে অনেকে বাধ্য হয়ে ভুঁয়া আইডি কার্ড্ তৈরি করছেন। যা আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ হলেও এ অপরাধ করতে বাধ্য করছে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। ইসির কর্মকর্তারা আরও বলছেন, এখনও জাতীয় পরিচয়পত্রের যথেচ্ছ ব্যবহারের মতো একটি সংবেদনশীন বিষয়ে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কমিশন। শুধু জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার বাধ্যতামূলক না করতে নিষেধ জারি করেই দায়সারা দায়িত্ব শেষ করেছে ইসি। সম্প্রতি ৫৩ হাজার ভুঁয়া জাতীয় পরিচয়পত্র উদ্ধারের দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে এ ঘটনার পরও টনক নড়েনি ইসির। তাদের দিক থেকে এখনেও পদক্ষেপ গ্রহণ বা কোনো আলোচনা হয়নি। ইসি সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে ভুঁয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে নানা অপরাধ হচ্ছে। মৃত মানুষের স্ত্রী সেজে অনেকে পেনশনের টাকা উত্তোলন করছেন। অনেকে বিদেশ যাচ্ছেন। এ ছাড়া ব্যাংক, বীমাসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের রেজিস্ট্রেশন নেওয়ার ক্ষেত্রেও এ ভুঁয়া জাতীয় পরিচয়পত্রের ব্যবহার হচ্ছে। জানা যায়, ভুঁয়া আইডি দুভাবে হচ্ছে। একটি হচ্ছে ইসির বাইরে কোনো দুষ্কৃতিকারী কোনো ছাপাখানায় এগুলো বানাচ্ছেন, যার কোনো তথ্য ইসির কাছে নেই। আবার ইসির ডাটাবেজে এমন অনেক আইডির নাম বা জন্ম তারিখ বা ঠিকানা পরিবর্তন করেও ভু&য়া আইডি তৈরি করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে ইসির জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগের কর্মকর্তারা অনেক সময় যাচাই-বাছাই না করেই আইডি সংশোধন করে দিচ্ছেন। ফলে ভুঁয়া আইডিতে পরিণত হচ্ছে প্রকৃত আইডি। এ অপরাধ রোধে করণীয় কী জানতে চাইলে ইসির কর্মকর্তারা বলেন, আইডি কার্ডের অপব্যবহার রোধে যেসব প্রতিষ্ঠান কমিশনের নির্দেশ অমান্য করে জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহারে বাধ্য করছে তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া। পাশাপাশি সবার জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানের পূর্বে এর বাধ্যতামূলক ব্যবহার বন্ধ করা। অন্যদিকে আইডি কার্ডে আরও গোপন নিরাপত্তা নম্বর বা হলমার্ক বা বারকোড ব্যবহার করা। বিভিন্ন মোবাইল ফোন কোম্পানি তাদের সিমকার্ড বিক্রির সময় জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি বাধ্যতামূলকভাবে জমা নিচ্ছেন। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলে এই পরিচয়পত্র নেওয়া হচ্ছে। বিকল্প হিসেবে তারা জন্মসনদ, এসএসসির সনদ কিংবা সংশ্লিষ্ট এলাকার কাউন্সিলর বা পৌরসভার মেয়র বা চেয়ারম্যানের প্রত্যয়নপত্র নিচ্ছে না। অথচ ১৬টি সেবা নেওয়ার সুবিধার্থে খুব ঘটা করে জন্মসনদ দেওয়া হয়েছিল। আজ সেই জন্মসনদ কোনো কাজে আসছে না। এ অবস্থা শুধু রাজধানীতেই নয় সারাদেশেই এভাবে জাতীয় পরিচয়পত্রের বাধ্যতামূলক ব্যবহার করা হচ্ছে। এ বিষয়ে মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়া উপজেলার ভবেরচর বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন স্মার্ট্ টেলিকমের কর্ণধার মোহাম্মদ ইসমাইল তানভির বলেন, মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি আবেদন ফরমের সঙ্গে জমা নিতে বলেছে। এজন্য অন্য কোনো পরিচয়পত্র জমা নেওয়া হয় না। রাজধানীর ধানমণ্ডি ১৯ নম্বর আবাহনী মাঠ সংলগ্ন সাউথইস্ট ব্যাংকের শাখায় হিসাব খুলতে আসা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী উত্তম কুমার দাস এ প্রতিবেদককে জানান, জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকলে অ্যাকাউন্ট খোলা যাবে না বলে ফিরিয়ে দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। একজন নাগরিকের জন্মসনদ কেন নেওয়া হবে না এমন প্রশ্নের প্রতিক্রিয়ায় ওই কর্মকর্তা বলেছেন, নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য শুধু জাতীয় পরিচয়পত্রকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। যা জন্মসনদপত্র দিয়ে সম্ভব নয়। কারণ জানিয়ে বলেছেন, জাতীয় পরিচয়পত্রে একজন নাগরিকের ছবি সংযুক্ত রয়েছে। অপর দিকে জন্মসনদপত্রে কোনো নাগরিকের ছবি সংযুক্ত না থাকায় সহজেই সত্যতা যাচাই করা সম্ভব নয়। জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক করার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ শাহ নেওয়াজ জানিয়েছেন, সরকারের অর্থ বিভাগকে জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক ব্যবহার না করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। কমিশন তার অবস্থান জানিয়েছে। এখন এ নির্দেশ বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব সরকারের অর্থ বিভাগের। অপরদিকে ইসির কর্মকর্তারা বলেছেন, সবার জাতীয় পরিচয়পত্র না হওয়া পর্যন্ত এটি বাধ্যতামূলক না করার কথা আইনেই বলা আছে। সেক্ষেত্রে যেকোনো নাগরিক বিষয়টি নিয়ে আদালতের কাছে প্রতিকার চাইতে পারেন। সম্প্রতি ৫৩ হাজার ভুঁয়া জাতীয় পরিচয়পত্র জব্দ হওয়ায় টনক নড়েছে সরকারের। অর্ধলক্ষ ভুঁয়া জাতীয় পরিচয়পত্র কীভাবে তৈরি হলো তা খতিয়ে দেখতে দুই সদস্যের একটি উপকমিটি গঠন করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।