সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে, মন বোঝার কেউ নেই!
রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ ওরা দুই সহোদর। নাম টিটু আর মিঠু। বয়স আনুমাণিক ১৫ বছর। প্রাণিজগতে ওদের পরিচয় ‘কালো ভাল্লুক’। বিপন্নপ্রায় এ প্রজাতির ওই দুই কালো ভাল্লুক জন্মের আড়াই মাস থেকেই বন্দি সাভারে। ওদের ঠিকানা ‘অরণ্যালয়’।
আসলে অরণ্যে নেই দুই ভাল্লুক। ‘অরণ্যালয়’ নামেরই সাভারের এক মিনি চিড়িয়াখানার বাসিন্দা ওরা। টিকিট কেটে অসংখ্য মানুষ ওদের দেখতে যান, তবে কেউ বোঝেন না ওদের মনের ভাষা। বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গীর অভাব আর দীর্ঘ সময় আবদ্ধ পরিবেশে থেকে ওদের মাঝে দেখা দিয়েছে মানসিক বৈকল্য। প্রতিটি মুহূর্তই কাটছে তীব্র মানসিক অবসাদে।
যন্ত্রণায় সময়ে সময়ে করছে অস্বাভাবিক আচরণ। কখনো হিংস্রতার প্রকাশ হিসেবে ভেঙে ফেলছে চিড়িয়াখানার খাঁচার গ্রিল। কখনো বা ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে থাকে দর্শণার্থীদের দিকে। যদি বা কেউ বুঝতে পারেন ওদের কষ্ট!
সাভারে বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের উল্টো দিকে সামরিক খামারে গড়ে উঠেছে মিনি চিড়িয়াখানা অরণ্যালয়। গজারি বন ঘেরা পরিবেশে ছোট্ট পরিসরে ১৯৯৯ সালে এ মিনি চিড়িয়াখানার উদ্বোধন করেন তৎকালীন সেনা প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান বীরবিক্রম।
সে সময় সেনাবাহিনীর একজন সদস্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি বনাঞ্চলে থেকে ভাল্লুক শাবক সহোদরকে নিয়ে আসেন এখানে। তখন তাদের বয়স ছিল প্রায় আড়াই মাস। সেই থেকে আজ পর্যন্ত দুই সহোদর রয়েছে ছোট্ট পরিসরের এ বন্দি খাঁচায়।
ইতোমধ্যে পেরিয়ে গেছে অর্ধেক জীবন। মায়ের স্নেহ আর ভালোবাসার সঙ্গে জঙ্গল জীবনের স্বাধীনতা উপভোগ করা হয়নি এই দুই সহোদরের। ভাল্লুকদের প্রিয় খাবার মধু কি জানে না এই সহোদর। চাক ভেঙে মধুর স্বাদ নেবারও সুযোগ হয়নি এ জীবনে। দুরন্তপনায় গাছে ওঠার সুযোগটুকুও মেলেনি বন্দি জীবনে।
আড়াই মাস বয়স থেকেই মা ছাড়া টিটু আর মিঠু। কিছু বুঝে ওঠার মানুষের হাতে ধরা পড়ে। তারপর থেকে বন্দি খাঁচায়। ওদের পৃথিবী বলতে এক চিলতে আকাশ। আর লোহার খাঁচার ফাঁক দিয়ে দৃষ্টির সীমানায় যা দেখা যাই তাই। পাশাপাশি খাঁচায় এখন অলস দিন কাটে।
তবে মিনি চিড়িয়াখানাটিতে ভাল্লুকের মনের অবস্থা বোঝার মতো নেই কোনো বিশেষজ্ঞ কিংবা বন্য প্রাণিবিদ।
দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেছে শৈশব, কৈশোরও শেষ। এখন মধ্যবয়সে দুরন্ত যৌবনেও দেখা মেলেনি বিপরীত লিঙ্গের কারো। যার কারণে এদের মধ্যে দেখা দিয়েছে তীব্র মানসিক বৈকল্য। দীর্ঘদিন ধরে আবদ্ধ পরিবেশে থাকতে থাকতে বিরক্ত এই প্রাণী দু’টি প্রায়ই করছে অস্বাভাবিক আচরণ।
জ্যৈষ্ঠ শুরুর পড়ন্ত এক বিকেলে ‘অরণ্যালয়ে’ প্রচণ্ড গরমে হাসফাঁস করছিলো ভাল্লুক দু’টি। পাইপ দিয়ে পানি ছিটিয়ে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন চিড়িয়াখানার তত্ত্বাবধানকারী আব্দুল মান্নান। বন্যপ্রাণি পরিচর্যায় তার নেই কোনো বিশেষ প্রশিক্ষণ। ভাল্লুক দু’টিসহ চিড়িয়াখানার অন্যান্য প্রাণীর খাবার ও দেখাশোনা করেন তিনি।
আব্দুল মান্নান জানান, ওজন বেড়ে যাবার ভয়ে মূলত নিয়ন্ত্রিত খাবার দেওয়া হয় ভাল্লুক দু’টিকে। সকালে দুই কেজি চালের ভাতের সঙ্গে একশ’ গ্রাম গুড়ো দুধ মিশিয়ে দেওয়া হয় দুধ-ভাত। বিকেলেও তাই। আর বাড়তি খাবার হিসেবে কখনো কখনো দেওয়া হয় শশা।
ভাল্লুক দু’টির অস্বাভাবিক আচরণ প্রসঙ্গে তিনি জানান, বেশ কয়েকবার প্রচণ্ড হিংস্রতায় এরা মোটা লোহার রড দিয়ে তৈরি খাঁচার রড পর্যন্ত ভেঙে ফেলেছে। নিজেই নিজেকে আঘাতে আঘাতে করেছে ক্ষত-বিক্ষত। কখনো কখনো পাশের খাঁচায় থাকা সহোদরের দিকে প্রকাশ করেছে তীব্র আক্রোশ।
বন বিভাগের স্তন্যপায়ী প্রাণিবিদ সৈয়দ মাহমুদুর রহমান জানান, বিষয়টি সম্পর্কে আমি আগে থেকেই জানি। আবদ্ধ পরিবেশে রাখলেও ওদের মানসিকতা বোঝার মতো সেখানে কেউ নেই। ওরাও তো প্রাণী। ওদের মানসিক প্রশান্তির জন্যে সেখানে খেলনা সামগ্রী রাখার প্রয়োজন। কিন্তু সেটা নেই। দুরন্ত যৌবনে পা রাখার পর থেকে প্রজনন মৌসুমে বিশেষ করে হিট পিরিয়ডে ওরা বেসামাল আচরণ শুরু করে। সে সময় ওরা হয়ে ওঠে হিংস্র আর ভয়ঙ্কর।
বংশরক্ষার কারণে ভাল্লুক দু’টির জন্যে বিপরীত লিঙ্গের স্ত্রী ভাল্লুক বেশি প্রয়োজন বলেও জানান এই প্রাণিবিদ।
তিনি জানান, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে আমাদের কখনো কোনো সহায়তা চান নি। চাইলে আমরা যেকোনো ধরনের সহায়তা দিতে প্রস্তুত। প্রয়োজনে একটি ভাল্লুককে সাফারি পার্কে বনের পরিবেশে রাখলেও সে অনেক স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারবে। অন্যটির জন্যে সেখানে স্ত্রী ভাল্লুক প্রতিস্থাপন করা জরুরি।
তিনি বলেন, ভাল্লুকের জুটি তো বাই বর্ন পাওয়া যাবে না। বাই চান্সে যাতে পাওয়া যায় সেদিকটাই অগ্রাধিকার দিয়ে খুঁজতে হবে।
ঢাকা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা শাহাব উদ্দিন জানান, ভাল্লুক বিপন্ন প্রায় প্রাণী। বন জঙ্গল কমে যাবার সঙ্গে সঙ্গে এদের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে। যে কারণে এখন এরা বিপন্নের তালিকায়।
তিনি জানান, অরণ্যালয় নামের মিনি চিড়িয়াখানায় বন্যপ্রাণী প্রদর্শন করা হলেও বিষয়টিতে তার দফতরের কোনো অনুমোদন নেই।
হয়তো তারা প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের অনুমোদন নিয়ে সেখানে বন্যপ্রাণি আবদ্ধ অবস্থায় রেখেছে মন্তব্য করে তিনি আরও জানান, ভাল্লুক দু’টির ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের কেউ কখনো বনবিভাগের সাথে যোগাযোগ করেন নি।
প্রধান বন সংরক্ষক ইউনূস আলী বলেন, বন্যপ্রাণী রক্ষায় আমরা সচেতন। ভাল্লুক দু’টির ব্যাপারে আমাদের সহায়তা চাইলে আমরা যেকোনো ধরনের পরামর্শ কিংবা সহায়তা দিতে আমরা প্রস্তুত।
বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক ড. তপন কুমার দে জানান, ভাল্লুক দু’টির জীবন রক্ষায় এখনই তাদের প্রয়োজন ব্রিডিং পার্টনার। সঙ্গিনীর অভাবে তারা যে অস্বাভাবিক আচরণ করছে ব্রিডিং পার্টনার পেলে হয়তো তারা কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হবে।
বন ও পরিবেশ মন্ত্রনালয়ের ওয়াইল্ড লাইভ অ্যাডভাইজারি বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক ড. মোস্তফা ফিরোজ জানান, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে মিনি জু বলে কিছু নেই। প্রাণীদের বসবাসযোগ্য পরিবেশ না করেই এভাবে মিনি জু করে মূলত বন্যপ্রাণি আইন লঙ্ঘন করা হচ্ছে।
অরণ্যালয় মিনি চিড়িয়াখানার নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ সেনাবাহিনীর ৯ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জানান, বিপন্নপ্রায় বন্যপ্রাণী রক্ষায় সম্ভব সব কিছুই করা হবে।
এদিকে প্রাণিপ্রেমীদের অভিমত, বনের মতো উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে পারলে এ কালো ভাল্লুক দেখতেও প্রচুর পর্যটকের সমাগম ঘটবে। বাইরের দেশগুলোতে বনের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ ইকো ট্যুরিজমের উন্নয়ন করা হচ্ছে।
তারা আরও বলছেন, বাসস্থান ধ্বংস এবং চামড়া, লোম, পিত্তথলি, দাঁত ও নখের জন্য শিকারের ফলে কালো ভাল্লুক বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। দ্রুত এদের সংরক্ষণে পদক্ষেপ না নিলে বাংলাদেশ থেকে চির বিদায় নেবে সুন্দর এই প্রাণীটি।