নিজাম হাজারীর আদি কথা!

Nizam Hajariরিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ফেনীঃ এক সময়কার ‘কেউটে সন্ত্রাসী’ থেকে ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য হওয়ার কাহিনী নিজাম হাজারীর। অস্ত্র মামলায় জেল খেটে বের হয়ে, রাতারাতি বদলে নিয়েছেন নিজেকে। ফেনীর এক সময়কার দোর্দণ্ড প্রতাপশালী জয়নাল হাজারীর হাত ধরে রাজনীতির মাঠে আসেন। এরপর গুরু বধের নেশায় মত্ত নিজাম হাজারী দখলে নেন ফেনীর নিয়ন্ত্রণ। 
 
আশির দশকে ফেনী কমার্স কলেজের ছাত্র থাকলেও চট্টগ্রাম এমএইচ এলাকায় সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন তিনি। সেখান থেকে ধীরে ধীরে অস্ত্র ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। এক্ষেত্রে আওয়ামীলীগের তৎকালীন প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রয়াত আখতারুজ্জামান বাবুর ছায়াতলেই ছিলো তার আশ্রয়। 

ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা একরামুল হককে গাড়ির ভেতর গুলি করে ও আগুন জ্বালিয়ে হত্যার পর গত দুইদিন সরেজমিনে ঘুরে অনেকের মুখে মুখেই ফিরছে এই নিজাম হাজারীর কথা। একসময়ের ত্রাস ও গডফাদার জয়নাল হাজারীর জ্ঞাতি তিনি। 
 
হাজারী পরিবারের সদস্য তারা। লমী হাজারী বাড়ির ছেলে নিজাম হাজারী এবং গণি হাজারী বাড়ির ছেলে জয়নাল হাজারী। পরস্পরে দুঃসর্ম্পকের জ্যাঠাতো ভাই।
 
নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় ফেনীর রাজনীতিতে জয়নাল হাজারীর হাত ধরেই আসেন নিজাম। ফেনীতে জয়নাল হাজারীর মিটিং মিছিলে অংশ নিতেন। ধীরে ধীরে জয়নাল হাজারীর ঘনিষ্ঠ সহচর হয়ে ওঠেন।
 
নিজ এলাকাতে পরিচিত না হলেও নানীর বাড়ি ফুলগাজী উপজেলায় আধিপত্য বাড়তে থাকে নিজামের। 
 
অস্ত্র মামলায় নিজাম হাজারী প্রথমবারের মতো কারাগারে যান ১৯৯২ সালের ২২ মার্চ। ওই বছরের ২৮ জুলাই তিনি জামিন পান।
 
আবারো ২০০০ সালে অস্ত্র মামলায় আটক হয়ে কারাগারে যেতে হয় নিজাম হাজারীকে। ২০০১ সালে জয়নাল হাজারী দেশান্তরী হলে ফেনী আওয়ামী লীগেও হতে থাকে নয়া মেরুকরণ। ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে নিজাম যখন জেল থেকে বের হন, জয়নাল হাজারী তখন ভারতে পলাতক। এ সময়টাতে জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক একরামুল হক একরামের ওপর ভর করে ফেনীতে নিজেকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় থাকেন নিজাম। 
২০০৫ এ নিজামকে সংবর্ধনা দেয়া হয় ফেনীতে। নিজাম ‍বুঝতে পারেন এখানে আওয়ামীলীগে অবস্থান তৈরী করতে হলে প্রয়োজন একরামকে এবং সুর মেলাতে হবে জয়নাল হাজারীর সুরে। 
 
ফেনীতে তিনি জয়নাল হাজারীর পক্ষে অবস্থান নিয়ে মিটিং মিছিল করতে থাকেন। জয়নাল হাজারীর অনুপস্থিতে একজোট হন নিজাম হাজারী, একরাম ও পৌর মেয়র দিদার। সময়ের ব্যবধানে গুরু জয়নাল হাজারীকে ফেলে একরামের আরও ঘনিষ্ট হন নিজাম হাজারী।
 
২০০৯ সালে জয়নাল হাজারী দেশে ফেরেন। নিজের জন্যে হুমকি হিসেবে ভাবতে থাকেন নিজাম ও একরামকে। তবে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে অবস্থান ফেরাতে ব্যার্থ হন জয়নাল। 
 
এদিকে শহরে নিজের অবস্থান আরো শক্ত করতে থাকেন নিজাম। তার অস্ত্রবাহিনীর কাছে জিম্মি ছিলো স্থানীয় প্রশাসন ও ব্যাবসায়ীরাও। তৎকালীন জেলা প্রশাসক আব্দুল কুদ্দুস খান ও ফেনী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমিনুল ইসলামের সহযোগীতা ছিলো এই কাছে, যা স্থানীয়দের মুখে মুখে। 
 
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর উপজেলা নির্বাচনে একরাম ফুলগাজীর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। আর ২০১১ সালে ফেনী পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন নিজাম উদ্দিন হাজারী। 
 
দলীয় কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ, টেন্ডার ভাগবাটোয়ারাসহ বিভিন্ন কাজে নিজামের সমান ভাগ বসান একরাম। ২০১২ সালের সম্মেলনে নিজাম উদ্দিন হাজারী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও একরাম ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচিত হন। 
 
তখন একরাম জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হতে চাইলেও নিজাম হাজারী বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগদানকারী হারুন-উর রশিদ মজুমদারকে ওই পদে বসান। নিজাম ছুঁড়ে ফেলতে চান এক সময়কার কাণ্ডারি একরামকে। 
 
নিজাম হাজারী ২০১১ সালের ১৮ জানুয়ারি ফেনী পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন। তার বিরোধীতা করায় এক সময়কার গুরু জয়নাল হাজারীর বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেন তিনি।
 
২০১২ এর ডিসেম্বরে জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলে নিজাম হাজারীর হাতে চলে আসে ফেনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। বিলোনিয়া বর্ডারের চোরাচালানির হিস্যা, নদী শাসনের বিশাল প্রজেক্ট ও মাদকদ্রব্য ব্যাবসায় একক নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেন তিনি।
 
এরপরর পৌর মেয়র পদ থেকে ইস্তফা না দিয়ে গত ৫ জানুয়ারি নিজাম হাজারী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হন। নির্বাচনে একরাম আওয়ামীলীগ থেকে মনোনয়নের জন্যে লবিং চালানোয় তার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন নিজাম। ফেনীর ৪ টি বালুমহাল আর টেন্ডারের নিয়ন্ত্রণে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে থাকেন একরাম। এই সুযোগে একরামের দিকে বন্ধুতের হাত বাড়িয়ে দেন জয়নাল হাজারী। 
 
ভবিষ্যৎ প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে একরামের ওপর ক্ষোভ বাড়তেই থাকে নিজাম হাজারীর। 
 
এদিকে গত ৫ বছরে ধীরে ধীরে ফেনীতে এক সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন তিনি। জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক জাহাঙ্গীর আদেল, ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ন সাধারন সম্পাদক জাহিদ চৌধুরীকে নিয়ে ফেনীতে অনেকটা ‘নিজের শাসন’ কায়েম করেন তিনি। 
 
পৌর কমিশনার গিটারের ভাই জিয়াউল আলম স্টারের হাতে দেন নিজের অস্ত্রবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ। ধীরে ধীরে জয়নাল হাজারী ও একরামকে করে দেন কোনঠাসা। 
 
গত উপজেলা নির্বাচনে একরামকে হারাতে নিজাম হাজারী প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি প্রার্থী মিনার চৌধুরীর সাথে হাত মেলান। তবে জয়নাল হাজারীর সহযোগিতায় উৎরে যান একরাম।

এরপর যা কিছু ঘটলো তা সবার সামনেই। গত ২০ মে দিনে দুপুরে প্রথমে গুলি পরে ছুরিকাঘাত অতঃপর গাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় একরামুল হক একরামকে। 

ঘটনার রাতে হেলিকপ্টারে ফেনীতে যান নিজাম হাজারী, তাও সকলেরই জানা।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ