আর নেই ঋতুপর্ণ
চলে গেলেন ভারতের চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষ। মাত্র ৪৯ বছরে তার এই মৃত্যুকে অকালপ্রয়াণ বলছেন সহকর্মীরা।
কলকাতার বাঙালি ঋতুপর্ণ ঘোষ বাংলাদেশেও চলচ্চিত্রাঙ্গনে ছিলেন প্রায় সমান জনপ্রিয়।
ভারতের সংবাদ মাধ্যম জানায়, কলকাতার বাড়িতে হৃদরোগে আক্রান্ত হলে ঋতুপর্ণকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নেয়া হয়। কিন্তু চিকিৎসকরা জানিয়ে দেন, মারা গেছেন এই চলচ্চিত্রনির্মাতা।
ইঙ্গমার বার্গম্যান আর সত্যজিত রায়কে আদর্শ হিসেবে নেয়া ঋতুপর্ণ মূলত বাংলা চলচ্চিত্রই বানাতেন। তার ১৯টি চলচ্চিত্রের মধ্যে ইংরেজি ও হিন্দি আছে মাত্র দুটি।
যে ১৯টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন এই বাঙালি, তার ১২টিই বিভিন্ন শাখায় ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জেতে। সেরা পরিচালক ও চিত্রনাট্যকারের পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন বেশ কয়েকবার। এছাড়া আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও রয়েছে তার।
২০১০ সালে নির্মিত ‘আবহমান‘ এর জন্য সর্বশেষ ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জেতেন চোখের বালি, নৌকাডুবির মতো আলোচিত বেশি কয়েকটি চলচ্চিত্রের এই নির্মাতা।
তার চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে- উনিশে এপ্রিল, দহন, সব চরিত্র কাল্পনিক, শুভ মহরত, তিতলি, অন্তরমহল, বাড়িওয়ালী, উৎসব, খেলা, সানগ্লাস ইত্যাদি।
হীরের আংটি’র মধ্য দিয়ে ১৯৯৪ সালে চলচ্চিত্র জগতে আসেন ঋতুপর্ণ। একই বছর ‘উনিশে এপ্রিল’ নির্মাণ করেন তিনি, যা তাকে এনে দেয় ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
তার নির্মিত সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র চিত্রাঙ্গদা।
হিন্দি চলচ্চিত্র রেইন কোট ২০০৪ সালে ভারতের সেরা হিন্দি চলচ্চিত্রের পুরস্কার পায়। এতে অভিনয় করেন ঐশ্বরিয়া রায়। এই অভিনেত্রী চোখের বালিতেও অভিনয় করেন।
ঐশ্বরিয়ার স্বামী অভিষেক বচ্চন অন্তরমহল-এ অভিনয় করেন।
২০০৭ সালে ভারতের সেরা ইংরেজি চলচ্চিত্র পুরস্কার বিজয়ী ঋতুপর্ণের একমাত্র ইংরেজি চলচ্চিত্র ‘লাস্ট লিয়ার’-এ অভিনয় করে অমিতাভ বচ্চন।
ইটিভি বাংলায় সম্প্রচারিত ‘এবং ঋতুপর্ণ’ ও স্টার জলসায় সম্প্রচারিত ‘ঘোষ অ্যান্ড কো’ অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতিও দর্শকদের কাছে প্রিয় করে তোলে এই চলচ্চিত্র নির্মাতাকে।
২০১০ সালে একটি জনমত জরিপে ‘দশকের সেরা বাংলা চলচ্চিত্রকার’ নির্বাচিত হন ঋতুপর্ণ। তিনটি চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন এই নির্মাতা।
ঋতুপর্ণ ঘোষের মৃত্যুর খবরে ভারতের চলচ্চিত্র জগতে শোকের ছায়া নেমেছে। টুইটারে বলিউড তারকারাও শোক জানাচ্ছেন।
চলচ্চিত্র নির্মাতা মধুর ভান্ডারকার টুইটে বলেছেন, এটা এক মহান চলচ্চিত্রকারের বিদায়।
ঋতুপর্ণের সঙ্গে কাজ করতে না পারার হতাশা প্রকাশ করেছেন অনুপম খের। তিনি লিখেছেন, কিছুদিন আগেই একটি চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন ঋতুপর্ণ। কিন্তু তা আর করা হলো না।
ঋতুপর্ণের চলচ্চিত্রে অভিনয় করা কঙ্কনা সেনশর্মা লিখেছেন , “তোমাকে মনে রাখবো।”
গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও কৃতী এই চলচ্চিত্র নির্মাতার অকাল মৃত্যুতে শোক জানিয়ে বলেছেন, ঋতুপর্ণ বেঁচে থাকবেন তার কীর্তিতে।
১৯৬৩ সালের ৩১ অগাস্ট কলকাতায় জন্ম ঋতুপর্ণের, তার ভাষায় একটি বামপন্থী শহরেই বেড়ে উঠেছেন তিনি।
ভারতজুড়ে মৌলবাদের উত্থান হলেও কলকাতাতে তার প্রভাব না পড়াকে এর কারণ বলে মনে করতেন এই নির্মাতা।
ঋতুপর্ণ পড়েছেন কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে, কিন্তু মনে করেছেন, তুলনামূলক সাহিত্য বা ইতিহাস পড়লেই ভালো করতেন তিনি।
চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে ঋতুপর্ণের জানাশোনা পারিবারিক আবহের কারণেই। তার বাবা ছিলেন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা, মা ছিলেন চিত্রকর।
ঋতুপর্ণ এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, কিশোর বয়স থেকেই বাবার সঙ্গে শ্যুটিংয়ে যেতেন তিনি। ওই বয়সেই ক্যামেরা চালানো শিখে যান; সম্পাদনা, চিত্রনাট্য লেখার হাতেখড়িও হয়ে যায় তখন।
নিজের নির্মিত সব চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য নিজেই লিখেছেন ঋতুপর্ণ। নিজেকে তিনি মনে করতেন, ভারতের ‘বুদ্ধিবৃত্তিক ধারার’ অন্যমত।
বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণে বেশি মনোযোগী থাকার বিষয়ে তার উক্তি- “আমি বাংলায় খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। আমার মূলও এতেই শক্ত”।