এখনো বিপুল অস্ত্র-গোলাবারুদ মজুদ !
রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, হবিগঞ্জঃ দেশের সীমান্তবর্তী হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার সাতছড়ির সংরক্ষিত বনাঞ্চলে শেষ হলো দুই দিনের অভিযান। উদ্ধার হয়েছে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গোলাবারুদ। এ নিয়ে নানা জনের নানা মত।তবে র্যাব কিংবা সরকারের পক্ষ থেকে এখনো বলা হয়নি উদ্ধার অস্ত্রগুলো কার। এদিকে ওই বনাঞ্চলে এখনো বিপুল অস্ত্র এবং গোলাবারুদ মজুদ রয়েছে বলে র্যাবের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ধারণা করছেন। তাদের ধারণায় শঙ্কিত দেশের জনগণ। র্যাব থেকে দাবি করা হয়েছে গহীন অরণ্য হওয়ায় অভিযান অব্যাহত রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। র্যাবের দাবি চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক ও বগুড়ায় উদ্ধার হওয়া অস্ত্রের সঙ্গে চুনারুঘাটে উদ্ধার হওয়া অস্ত্রগুলোর মিল রয়েছে। এদিকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের ঘটনায় চুনারুঘাট থানায় দুটি পৃথক মামলা করেছে র্যাব। বুধবার রাতে র্যাব-৯ শ্রীমঙ্গল ক্যাম্পের ডিএডি সামিউল ইসলাম বাদী হয়ে মামলা দুটি করেন। চুনারুঘাট থানার ওসি অমূল্য চৌধুরী জানান, অস্ত্র আইনে একটি ও বিস্ফোরক আইনে অপর মামলাটি করা হয়েছে। মামলাগুলোতে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে। বুধবারের অভিযান শেষে নয়টি বাঙ্কার থেকে একটি মেশিনগান, একটি রকেট লাঞ্চার, ৫টি মেশিগানের ব্যারেল, ২২২টি কামানের গোলা ও গোলা ছোড়ার কাজে ব্যবহারের ২৪৮টি চার্জ এবং বিভিন্ন ধরণের ১২ হাজার ৯৮৭টি গুলি উদ্ধারের কথা জানিয়েছে র্যাব। এছাড়াও ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ত্রিপুরা পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (টিপিডিএফ) সংগঠনের কিছু কাগজপত্র পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ওই গহীন অরণ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন টিপিডিএফ সদস্যরা উদ্ধার হওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ রেখেছিল। তবে র্যাবের মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমান জানান, এখানে অস্ত্র উদ্ধারের অভিযান চলছে। অভিযান শেষে তদন্ত হবে। এরপর বলা যাবে অস্ত্র ও গোলাবারুদ কার ছিল। বুধবার দিনভর সরেজমিনে সাতছড়ির পাহাড়ের টিলায় ত্রিপুরা বস্তির ২২ পরিবারের তিনজন নারী এবং একজন শিশু ছাড়া আর কাউকে পাওয়া যায়নি। সেখানে বসবাসের সব ধরনের আলামত পাওয়া গেছে। ২২টি বস্তির মধ্যে পরিত্যক্ত তিনটি বস্তিতে নয়টি বাঙ্কারে অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করে র্যাব। টিলার ওপরে বস্তির বারান্দায় একটি নাম্বারবিহীন মোটরসাইকেল দেখা গেছে। অপর একটি ঘরে ফার্নিচার রয়েছে। তবে ঘরে দরজা খোলা রাখা ছিল। র্যাবের পরিচালক (লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া) উইং কমান্ডার এ টি এম হাবিবুর রহমান বুধবার দুপুর দেড়টায় অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফকালে জানান, রোববার রাত থেকে ডগ স্কোয়াড, বোমা ডিস্পোজাল টিমসহ আধুনিক প্রযুক্তিতে দক্ষ ও শক্তিশালী টিম নিয়ে সাতছড়ির তিনটি টিলায় অভিযানে নামে র্যাব। এ সময় ওই টিলাগুলোতে ৯টি বাঙ্কারের সন্ধান পাওয়া যায়। বাঙ্কারগুলোতে মঙ্গল ও বুধবারের অনুসন্ধানে ৪টি মেশিনগান, মেশিনগানের অতিরিক্ত ৫টি ব্যারেল, ২২২টি রকেট, ২৪৮টি রকেট লাঞ্চারের চার্জার, একটি রকেট লাঞ্চার, মেশিনগানের ১ হাজার ২২২টি গুলি, ১১ হাজার ৬৬৭টি ক্ষুদ্রাস্ত্রের গুলি, ১৯টি ম্যাগাজিন, ২টি বেল্ট, সমরাস্ত্র পরিষ্কারের তেল (ল্যান্ডসিড অয়েল আইএসও ভেসকো সিটি গ্রেট ৪৬), ১২টি সমরাস্ত্র পরিষ্কারের ইকুইপমেন্ট উদ্ধার করে। হাবিবুর রহমান আরও জানান, সাতছড়িতে উদ্ধার অস্ত্রের সঙ্গে ইতোপূর্বে চট্টগ্রামে উদ্ধার ১০ ট্রাক ও বগুড়ায় কাহালুতে উদ্ধার অস্ত্রের সাদৃশ্য রয়েছে। তবে এ অস্ত্র মজুদের সঙ্গে কারা জড়িত তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তদন্তের মাধ্যমে তা উদঘাটন করা হবে। ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, অস্ত্র পাওয়া স্থানগুলোতে এক সময় অল ত্রিপুরা টাইগার ফোর্সের (এটিটিএফ) আস্তানা ছিল বলে মনে করা হয়। ত্রিপুরার এই বিদ্রোহী দলটি এখন দুর্বল হয়ে পড়েছে। এদিকে ভারতের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা বলছে, এটিটিএফের এই আস্তানাটি আসামের বিদ্রোহী সংগঠন উলফাও অস্ত্র পাচারের জন্য ব্যবহার করত। এটিটিএফ এর প্রধান রঞ্জিত দেবর্মা বর্তমানে গ্রেপ্তার হয়ে ত্রিপুরার কারাগারে রয়েছেন। বলা হয়, তিনি ২০১৩ সালে বাংলাদেশে আটক হয়েছিলেন, পরে তাকে ভারতের হাতে তুলে দেয়া হয়। দেবর্মার সঙ্গে উলফার সামরিক প্রধান পরেশ বড়ুয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। পরেশ বড়ুয়া চট্টগ্রামে আটক ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত। ওই অস্ত্র উলফার জন্য আনা হয়েছিল বলে আদালতে প্রমাণিত হয়েছে। পরেশ বড়ুয়া পলাতক রয়েছেন। ধারণা করা হয়, ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে লুকিয়ে আছেন তিনি। ভারতীয় গোয়েন্দারা বলছেন, উলফা ও এটিটিএফ কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে অস্ত্র আনত, তারপর তা নিয়ে রাখা হত হবিগঞ্জের সাতছড়ির আস্তানায়। র্যাবের মুখপাত্র হাবিব জানান, র্যাবের নিজস্ব গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সেখানে অভিযান চালান তারা। তবে তার আগে ৪/৫ দিন ধরে ওই এলাকায় অনুসন্ধান চালিয়ে আসছিলেন র্যাব সদস্যরা। ব্রিফিংয়ে র্যাবের মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমান, অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান, মিডিয়ার সহকারী পরিচালক মাকসুদ ক্যাপ্টেন, র্যাব-৯ এর কমান্ডিং অফিসার মুফতি মাহমুদ, র্যাব-৯ শ্রীমঙ্গল ক্যাম্পের কমান্ডিং অফিসার এএসপি সানা শামীনুর রহমান, হবিগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শহীদুল ইসলাম, সহকারী পুলিশ সুপার মোজাম্মেল হক ও চুনারুঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অমূল্য কুমার উপস্থিত ছিলেন। ব্রিফিংয়ের আগে বুধবার বেলা সাড়ে ১২টায় র্যাবের মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমানসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের নিয়ে বাঙ্কারগুলো পরিদর্শন করেন। এর আগে ২০০৩ সালে বগুড়ায় উদ্ধারকৃত গোলাবারুদের ট্রাকের চালক আশিষ দেব বর্মনের বাড়ি এই সাতছড়ি পাহাড়েই। সাতছড়ির সংরক্ষিত বনবিভাগের অফিসারের কার্যালয় থেকে ৩০০ মিটার দূরত্বে ২২টি পরিবার বসবাস করে। উদ্ধার হওয়া বাঙ্কারের সামনের একটি ঘরে তিনজন বৃদ্ধা ও একজন শিশু ছিল। ওই তিনজনের একজনের নাম পুষ্প রানী বর্মন। তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করা হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি। এছাড়াও ওই বস্তির আরো একটি ঘরে অনুসন্ধান চালিয়ে পারুল দেব বর্মনের নামে একটি কাগজ পাওয়া যায়। সেখানে উপস্থিত স্থানীয় চুনারুঘাট এলাকার স্কুলছাত্র শরীফ জানান, এখানে গত ৪-৫ দিন আগেও লোক দেখেছি। এছাড়াও তারা কয়েকজন সাতছড়িতে দোকানে ব্যবসা করত। এদিকে সাতছড়ির বণ্যপ্রানীর রেঞ্জ অফিসার একেএম মুনির আহমেদ খান জানান, ত্রিপুরা দক্ষিণ-পূর্ব কোনায় ২২টি বস্তিসহ মোট ৩৭৫০ একর জায়গা তাদের নিয়ন্ত্রণে। সেখানে জাতীয় উদ্যানের জায়গা রয়েছে ৬০০ একর। মোট জনবল মাত্র নয়জন। এত বড় একটি জায়গায় কে কোথায় কি করছে তা আমার জানার বাইরে। এছাড়াও এলাকাটি দুর্গম পাহাড়। এখানে গত ২০০৬ সালে ভারতের ত্রিপুরাদের সঙ্গে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ হয়। ওই সংঘর্ষে বিপুল পরিমাণ গুলি ও গোলাবারুদ ব্যবহার করা হয়। তিনি জানান, আমরাও অস্ত্র ব্যবহার করি। অভিজ্ঞতা হিসেবে উদ্ধার হওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদগুলো অনেক পুরোনা বলে মনে হচ্ছে।