প্রতিরক্ষা খাতের বরাদ্দ নিয়ে আলোচনা জরুরি
সিনিয়র রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপনের আগে-পরে কৃষি, শিক্ষা, প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, সামাজিক নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা হয়। এ প্রক্রিয়ার ফলে বাজেট প্রস্তাব সংশোধন ও পরিমার্জনের সুযোগ তৈরি হয়। কিন্তু সশস্ত্র বাহিনী এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত, কারণ প্রতিরক্ষা বাজেট কেমন হওয়া উচিত, কীভাবে কোন বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বাজেট বাস্তবায়িত হওয়া উচিত, কী ধরনের যুদ্ধাস্ত্র প্রয়োজন, সাংগঠনিক কাঠামোয় কিরূপ সংস্কার জরুরি ইত্যাদি বিষয়ে সংসদে বা সংসদের বাইরে কখনো উল্লেখযোগ্য কোনো আলোচনা হয় না।
এ খাতে বরাদ্দের প্রক্রিয়া, স্বচ্ছতা ও যৌক্তিকতা নিয়ে সংসদের বাইরে গণমাধ্যমে ও বিভিন্ন সেমিনারে সামান্য আলোচনা-সমালোচনা হলেও সে আলোচনা কোনো কাজে আসে না। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বা সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের পক্ষ থেকেও প্রতিরক্ষা বাজেট নিয়ে কোনো ধরনের মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয় না। অথচ, প্রতিবছরই এ খাতে বাজেট বরাদ্দ বেড়ে চলেছে। ২০১২ সালে স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই) প্রকাশিত এক রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৮৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সামরিক খাতে বাংলাদেশের ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১২ গুণ। ১৯৮৮ সালে যেখানে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় ছিল ১,০০৪.৫০ কোটি টাকা, সেখানে ২০১২-১৩ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ১২ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল ১৪ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা, যা মোট সরকারি ব্যয়ের ৬ থেকে ৭ শতাংশ (অবশ্য, এ খাতে প্রকৃত ব্যয় প্রতিবছরই বিভিন্ন কারণে বৃদ্ধি পায়)। গত অর্থবছরের তুলনায় এ বরাদ্দ ১২ দশমিক ১৮ শতাংশ বেশি। সংশোধিত বাজেটে এ বরাদ্দ হয়তো আরও বাড়বে। গত বাজেটগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রতিরক্ষা খাতে জিডিপির ১ দশমিক ৩ থেকে ১ দশমিক ৫ শতাংশ বরাদ্দ হয়ে আসছে (যদিও তা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় অর্ধেক বা তারও কম)।
২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ এবং সশস্ত্র বাহিনীকে একুশ শতকের উপযোগী করে গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তিনি সশস্ত্র বাহিনীর অপারেশনাল কার্যকারিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র কেনা এবং সাংগঠনিক অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানান। যদিও তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু বলেননি। ২০১৩-১৪ সালের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী জানান, বিগত তিন বছরে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা পাঁচ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে।
বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত স্পষ্টবাদিতা ও পাণ্ডিত্যের জন্য সুপরিচিত। ১৯৯১ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ পুনর্গঠন ও জাতীয় ঐকমত্য গ্রন্থে তিনি মত প্রকাশ করেন যে ‘দেশের সম্পদের একটি বিরাট অংশ সামরিক অপব্যয়ে উবে যায়’, (পৃ. ৩৯-৪০)। বাজেট বরাদ্দে সামরিক খাতে অনেক লুক্কায়িত খরচও সংযোজিত হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন, (পৃ. ৬৬)। তিনি আরও লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে প্রতিরক্ষা খাতে খরচ অনবরত বাড়ছে …সমরাস্ত্র ব্যবসায় স্বভাবতই নৈতিকতার কোনো স্থান নেই। দুর্নীতির প্রসার, প্রভাব বলয়ের বিস্তার এবং রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি অস্ত্র ব্যবসায়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত’, (পৃ. ১৪৩)। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত তাঁর রাজনৈতিক ঐকমত্যের সন্ধানে গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, প্রতিরক্ষা প্রস্তুতিতে ‘মূল্যবান সম্পদের অপচয় হচ্ছে, বিনিয়োগের জন্য সঞ্চয় থাকছে না’। এ ছাড়া, ‘সামরিক খাতে ব্যয় দুর্নীতির প্রসারে বিশেষ অবদান রাখে এবং বাংলাদেশে তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না, (পৃ. ৩০-৩১)। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘এ দেশে নিরাপত্তা কৌশল নিয়ে কোনো আলোচনা হয় না’, (পৃ. ৭২)। সর্বোপরি তিনি জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বাজেট বিষয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার এবং খোলামেলা আলোচনার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
অনুমান করি, অর্থমন্ত্রী হিসেবে গত কয়েক বছর তিনি জাতীয় নিরাপত্তা বিধানে সশস্ত্র বাহিনীর দায়িত্ব ও গুরুত্ব সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে জানার সুযোগ পেয়েছেন, উপলব্ধি করেছেন, দেশে শক্তিশালী ও আধুনিক সশস্ত্র বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সে কারণেই তিনি সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়ন এবং একুশ শতকের উপযোগী সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলার প্রত্যয়ে প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করে চলেছেন। নাগরিক সমাজ দেশের প্রতিরক্ষা নীতি ও প্রতিরক্ষা বাজেট সম্পর্কে জানার সুযোগ পেলে নিশ্চয়ই তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ অভিমত দেশের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে আরও সুসংহত ও শক্তিশালী করতে সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়। উল্লেখ্য যে দেশের সব বড় রাজনৈতিক দল সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিক, যুগোপযোগী এবং শক্তিশালী করে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছে। সরকারে থাকাকালে বিএনপিও সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নের কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রকাশিত আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দেশের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষার্থে সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়ন ও সংস্কারের প্রতিশ্রুতি ছিল। একই সঙ্গে ছিল প্রতিরক্ষা নীতি প্রণয়নের ওয়াদা।
(প্রথম আলাে থেকে সংগৃহীত)