আমলাতন্ত্রের ফাঁদে আইন কমিশন
সিনিয়র রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ আইন কমিশনের কাজ হলো সেকেলে আইন বাতিল, আদালতে বিচারিক আমলাতন্ত্র দূর করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত ও আইনের যুগোপযোগী করণের সুপারিশ করা। অথচ আইন কমিশনই এখন আমলাতন্ত্রের ফাঁদে আটকে আছে। ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬ সালে স্থায়ী আইন কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। আঠারো বছরের পুরোনো আইনে ধুকে ধুকে চলছে কমিশন। যদিও ২০০১ সালে নামকাওয়াস্তে সংশোধনী আনা হয় তবুও আইন আদালত আর ন্যায়বিচারের ওয়াচডগ হিসেবে পরিচিত এই প্রতিষ্ঠানটি এখন হরেক রকমের আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় হাঁসফাঁস করছে। কমিশনের বর্তমান মূল সমস্যা লোকবলের অভাব-এমনটা জানালেন কমিশনের ঊর্ধ্বতন গবেষণা কর্মকর্তা মাসুদুল হক। আইন কমিশন আইন ১৯৯৬ ’র ৭ ক(১) এ বলা আছে-কমিশনে প্রয়োজনীয় সংখ্যক গবেষণা কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হবে এবং তাদের চাকরির শর্তাবলী বিধি দ্বারা নির্ধারিত হবে। কমিশনে বর্তমানে তিন জন গবেষণা কর্মকর্তা আছেন। তাদের মধ্যে দু’জন প্রায়ই অসুস্থার জন্য ছুটিতে থাকেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কমিশনের সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ড.শাহ আলম এবিসি নিউজ বিডিকে বলেন, পর্যাপ্ত আর্থিক সুবিধা না থাকার কারণে গবেষকরা এখানে আসতে চান না। আসলেও কেউ বেশিদিন থাকেন না। বিদেশে স্কলারশিপ অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেলে চলে যান। সরকার চাকরির সুযোগ-সুবিধা কেন বাড়াচ্ছে না-এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, চাকরির সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর জন্য সরকারের কাছে বিধি প্রণয়নের সুপারিশ করেছি, কোনো কাজ হয়নি। আইন কমিশনের ওয়েবসাইট ঘেটে দেখা যায় ২৩ ডিসেম্বর ১৯৯৯ সালে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুযোগ সুবিধা সম্বলিত একটি প্রস্তাব সরকারের কাছে পেশ করা হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তারা সরকারের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমিশনের একজন কর্মকর্তা এবিসি নিউজ বিডিকে বলেন, ভাই আমরা উদ্বাস্তুর মতো পইড়া আছি, পদোন্নতি নাই স্টাফ হইয়া ঢুকছি স্টাফ হইয়া পইড়া আছি। কর্মচারীদেরর ‘ব্লক পোস্ট’ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে ড.শাহ আলম বলেন, এই সমস্যাটা বহুদিন যাবৎ চলছে। কর্মচারীদের চাকরি বিধি দরকার কিন্তু কোনো চাকরির বিধি নাই। সরকার লোকবল কেন দিচ্ছে না-এমন প্রশ্নের জবাবে মাসুদুল হক বলেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, লোক নিয়োগের জন্য প্রথমে আইন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠাতে হয়, মন্ত্রণালয় সুপ্রিম কোর্টের কাছে প্রস্তাব দেয় সুপ্রিমকোর্ট নিজেদের কোর্ট খালি করে কমিশনে কর্মকর্তা দিতে চায় না। কারণ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সাধারণত বিচারবিভাগ হতে নিয়োগ দেওয়া হয়। গোপন সূত্রে জানা যায়, গত জুলাই মাসের শেষ দিকে আইন মন্ত্রণালয়ে লোকবল চেয়ে আবারও প্রস্তাব পাঠানো হয় কিন্তু এখন পর্যন্ত মন্ত্রণালয় কোনো উত্তর দেয়নি। আইনের ৬ক ধারায় বলা আছে ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলায় দীর্ঘ সূত্রিতার কারণ এবং উত্তরণের উপায় বের করা আইন কমিশনের অন্যতম দায়িত্ব। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দেশের উচ্চ আদালতে ও নিম্ন আদালতে প্রায় ২২ লাখ মামলা ঝুলে আছে। এ ব্যাপারে ড. শাহ আলম বিরক্তি নিয়ে বলেন, যা প্রস্তাব করেছি তা আগে পাশ হোক। তবে তিনি এও উল্লেখ করেন যে, র্দীঘসূত্রিতা কমানোর জন্য আমরা (বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি) এডিআর প্রস্তাব করেছি। সরকার সেটা পাশ করেছে, এটা আমাদের অর্জন। কথোপকথনের কোনো এক পর্যায়ে ড. শাহ আলম আক্ষেপ করে বলেন, আমি শেষ সময়ে কারো সঙ্গে ঝগড়া করতে চাই না, সাক্ষীরা সব সময় হুমকির মুখে থাকে। তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। তাদের সুরক্ষার জন্য আমরা সাক্ষী সুরক্ষা আইনের প্রস্তাব করেছি অথচ সেই প্রস্তাব আড়াই বছর ধরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পড়ে আছে, বাস্তবায়নের নামগন্ধ নেই। এ বিষয়ে সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকুকে প্রশ্ন করলে মুঠোফোনে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। আইনের ৯(২) ধারায় উল্লেখ আছে প্রতিবছর আইন মন্ত্রণালয় কমিশনের প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য সংসদে উত্থাপন করবে কিন্তু মন্ত্রণালয় কোনো প্রতিবেদন সংসদে পেশ করে না, এমন অভিযোগ কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। এ ব্যাপারে সরকারের সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে আমি কিছু বলতে পারব না। যারা পদে আছে তাদের জিজ্ঞাসা করুন। বহুবার যোগাযোগ করেও আইন সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। অবশেষে আইন মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিবের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে এ ব্যাপারে তিনি মুখ খুলতে চাননি। একই ধারায় বলা আছে আইনের অপব্যবহার রোধে কমিশন সুপারিশ করবে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সংবিধানের ৩৫(৩) অনুচ্ছেদে বলা আছে, প্রত্যেক অপরাধী স্বাধীন ও প্রকাশ্য আদালতে বিচারের অধিকারী হইবে। অথচ ক্রস ফায়ারের নামে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। এমনকি যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইন ২০০৩ এর মাধ্যমে ক্রসফায়রকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদে বলা আছে ব্যক্তিকে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ছাড়া ২৪ ঘণ্টার বেশি আটক রাখা যাবে না, আটকের পর তাকে কেন আটক করা হয়েছে তা জানাতে হবে এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য উকিল নিয়োগ দিতে হবে। ১৯৭৩ সালে সংবিধানের তৃতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে উপ-অনুচ্ছেদ ৩ যোগ করে বলা হয়েছে, তবে এই নিয়ম নিবর্তনমূলক আটকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। এই উপ-অনুচ্ছেদের সূত্র ধরে ১৯৭৪ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইন পাশ করা হয়, আইনের ৩ ধারায় নিবর্তনমূলক আটকের সংজ্ঞায় বলা হয়, ব্যক্তিকে অপরাধ হতে নিবৃত রাখার জন্য বিনা বিচারে ছয় মাসের অধিক আটক রাখা যাবে, কোনো কারণ দর্শানো ছাড়া। এই আইনকে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিকভাবে অপব্যবহার করা হয়েছে। জরিপে দেখা গেছে, ১৯৯৫ সালে বিএনপি সরকার বিরোধী দলের ৪১৭৩ জনকে বিনা বিচারে আটক রেখেছে। ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী দলের ২৫৩৯ জনকে বিনা বিচারে আটক রেখেছে। (সূত্র স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) বিভিন্ন সময়ে এ ব্যাপারে বিতর্ক উঠলেও আইন কমিশন মুখ খোলেনি। আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া বলেন, এটা একটা কালো আইন, আইন কমিশনের উচিত এই আইনটা বাতিলের সুপারিশ করা। এ ব্যাপারে কমিশনের একজন ঊর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, লোকবলের অভাবে কিছুই করা যাচ্ছে না, তবে নতুন চেয়ারম্যান (এবিএম খাইরুল হক) এসে বেশ কিছু কাজ হাতে নিয়েছেন। আশা করি, এবার আমরা এসব সমস্যা সমাধানের সুপারিশ করতে পারবো। উল্লেখ্য, দণ্ডবিধি ১৮৬০, ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮, দেওয়ানি কার্যবিধি ১৯০৮, সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ ’র মতো গুরুত্বপূর্ণ আইন ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত আইন কমিশনের সুপারিশে পাশ হয়েছে।