থামছেই না শিক্ষার্থীদের শারীরিক নির্যাতন
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক নির্যাতন থামছে না। আইনের তোয়াক্কা না করে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় শিক্ষকদের মারধরের শিকার হচ্ছেন ছাত্র-ছাত্রীরা। এ পরিস্থিতিতে স্বভাবতই উদ্বেগ বাড়ছে অভিভাবকদের।
রাজধানীর ক্যামব্রিয়ান কলেজে ১১ জন শিক্ষার্থীকে মারধরের পর আলোচিত আর একটি ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার এক মাদ্রাসায়। এক ছাত্রকে পিটিয়ে অজ্ঞান করেছেন এক শিক্ষক।
জনস্বার্থে করা এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০১১ সালের ১৩ জানুয়ারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারীরিক ও মানসিক শাস্তির নামে শিক্ষার্থীকে নির্যাতন করা অবৈধ, অসাংবিধানিক, মৌলিক অধিকার পরিপন্থি বলে রায় দেন।
রায়ের মূল বক্তব্যের সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও ঐকমত্য পোষণ করে। ওই বছরের ২১ এপ্রিল শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তি না দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে নীতিমালা জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীদের মারধর করতে পারবেন না এবং তাদের উদ্দেশ্যে অশালীন মন্তব্য বা অশোভন অঙ্গভঙ্গী করতে
পারবেন না। নীতিমালা লঙ্ঘন করলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রাখা হয়।
কিন্তু উচ্চ আদালতের রায় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আদেশ সত্ত্বেও দেশের শহর ও মফস্বলের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্কুল-মাদ্রাসায় বেত্রাঘাতসহ ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে।
মাদ্রাসা ছাত্রকে ৫০০ বেত্রাঘাত
মঙ্গলবার সীতাকুণ্ডের একটি হেফজখানায় আবদুর রহমান নামের এক শিক্ষক ইউছুপ খান নামের ছাত্রটিকে অন্তত ৫০০ বেত মারেন। সোনাইছড়ি ইউনিয়নের দক্ষিণ ঘোড়ামরা গ্রামের ইবনে আব্বাস (রহ.) হেফজখানার ওই ছাত্র এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। পরে পল্লী চিকিৎসক তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন।
হেফজখানার বড় হুজুর আবদুল মান্নান গণমাধ্যমকে বলেন, শিক্ষক আবদুর রহমান অন্তত ৫০০ বেত মেরেছেন শিক্ষার্থী ইউছুপকে। পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষককে বহিষ্কার করার কথা বলেন তিনি।
কথিত মোবাইল ফোন খোয়া যাওয়ার জন্য ইউছুপকে দায়ী করে হাত-পা বেঁধে বেত দিয়ে মারধর করেন আবদুর রহমান। স্থানীয়রা তাকে ধরে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছেন।
ঘুরে ফিরে ক্যামব্রিয়ানের নাম
গত ২২ মে ক্যামব্রিয়ান স্কুলের ১১ শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে আহত করা হয়। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে রাজধানীর অ্যাপোলো ও ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মারধর করা হয়।
প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান এমকে বাশারের অনুমতি ছাড়া অধ্যক্ষ দিলরুবা এ বিষয়ে কোনো কথা বলেননি।
তবে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করে বারিধারা-তিন ক্যাম্পাসের হোস্টেল সুপার সাইফুল ইসলাম বলেছিলেন, “বিদায় অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে মাত্র।”
ফেব্রুয়ারিতে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করায় ১৫ ছাত্রকে নিজ হাতে পিটিয়েছিলেন ক্যামব্রিয়ানের মালিক লায়ন এমকে বাশার। সে সময় একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও আর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
আহত ছাত্রদের অভিভাবকরা গুলশান থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করলে ভয় দেখিয়ে তা প্রত্যাহারের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জিডি না তুলে নিলে ছেলেরা কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েও ভালো ফল লাভ করতে পারবেন না- হুমকি দেন ক্যামব্রিয়ানের মালিক। ক্যামব্রিয়ানের বিরুদ্ধে অযোগ্য ও অভিজ্ঞ শিক্ষকদের দিয়েও পড়ানোর অভিযোগ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞ মত
সরকার আইন করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ করলেও তা অগ্রাহ্য করা হচ্ছে বার বার।
শিশু সংগঠন চাইল্ড পার্লামেন্টের এক জরিপে দেখা গেছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৬৮ শতাংশ শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন কারণে শিক্ষকদের হাতে শাস্তি পেতে হয়েছে।
মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি জানিয়েছেন, “কওমি মাদ্রাসাগুলোকে সরকারি নীতিমালার মধ্যে নিয়ে আসা হবে। এ লক্ষ্যে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশন-২০১২ গঠন করা হয়েছে। এ কমিশন শিক্ষানীতি-২০১২ এর খসড়া প্রণয়ন করেছে।”হেফজখানাসহ কওমি মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থীকে শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ বেশি। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বার বার শিক্ষকদেরকে ছাত্রদের শারীরিক নির্যাতন না করার আহ্বান জানিয়ে আসছেন।
তবে ইউনিসেফের শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ আমিনুল ইসলাম আমিনুল ইসলাম বলেন, শুধু আইন থাকলেই হবে না, মনিটরিং ও অভিযোগ মেকানিজমের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
পাশাপাশি হেফজখানাসহ কওমি মাদ্রাসার মতো আবাসিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য একটি নীতিমালা করতে হবে।
একটি স্বাধীন নিরপেক্ষ ‘শিশু ন্যায়পাল’ করার পরামর্শ দিয়ে এই শিশু বিশেষজ্ঞ শিশু নীতিমালা বাস্তবায়নের তাগিদ দেন।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, ২০০৯ সালে করা শিশু নীতিমালা অনুসারে কাজ করবেন তিনি।