সুইস ব্যাংকের তালা খোলা কঠিন হবে
রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের টাকা উদ্ধারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৮ জুন জাতীয় সংসদে বক্তব্য দেন। এর তিন দিন পর গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে সুইজারল্যান্ডের এফআইইউর কাছে সুইস ব্যাংকগুলোতে গচ্ছিত বাংলাদেশিদের অর্থের বিস্তারিত তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
কিন্তু সুইস ব্যাংকের তালা খোলা বাংলাদেশের জন্য সহজ হবে না। ভারতীয়রাও চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে অনেকটাই সফল হচ্ছে প্রভাবশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউর সূত্রগুলো বলছে, সুইস ব্যাংকগুলোতে থাকা বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থ সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য পেতে এখন পর্যন্ত যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাতে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এভাবে ঢালাও তথ্য চেয়ে তা পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। তবে বিশেষ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো গুরুতর অনিয়মের জন্য সরকারি তদন্ত চলমান থাকলে সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে তথ্য চাওয়া হলে তা পাওয়া যেতে পারে। অথবা কোনো তালিকা পাঠালেও সে ক্ষেত্রে সুইস ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (এফআইইউ) থেকে তথ্য মিলতে পারে।
প্রতিবেশী ভারত তিন-চার বছর ধরে সুইস ব্যাংকে ভারতীয় নাগরিকদের জমা করা অর্থের তথ্য চেয়ে আসছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো তথ্য সুইজারল্যান্ড তাদের দেয়নি।
সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসএনবি সম্প্রতি ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড ২০১৩’ শীর্ষক বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অর্থাৎ ২০১৩ সাল শেষে সুইস ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশিদের অন্তত ৩৭ কোটি ১৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ গচ্ছিত রয়েছে, যা প্রায় ৪১ কোটি ৪০ লাখ ডলার বা তিন হাজার ১৬২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। এটি নতুন অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে সরকার যে পরিমাণ প্রকৃত ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছে, তার প্রায় ৬ ভাগের ১ ভাগ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সরকার নিট বিদেশি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ১৮ হাজার ৬৯ কোটি টাকা। বাংলাদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের এই অর্থ সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে গচ্ছিত রয়েছে।
এর আগে ২০১২ সাল শেষে সুইস ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশিদের অন্তত ২২ কোটি ৮৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ গচ্ছিত ছিল, যা প্রায় ২৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার বা এক হাজার ৯০৮ কোটি টাকার সমান।
উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ না থাকলেও সুইস ব্যাংকে কালোটাকা রাখার বিষয়টি নিয়ে দেশে নানা ধরনের রাজনৈতিক বক্তৃতার পালা চলছে। প্রধানমন্ত্রী সংসদের বাইরেও এ নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, বিএনপির শীর্ষ নেতারা টাকা পাচার করেছেন। পাল্টা বক্তব্যে বিএনপি তালিকা প্রকাশ চেয়ে বলছে, সরকারি দলের শীর্ষ নেতারাই সুইস ব্যাংকে অবৈধভাবে টাকা রাখছেন।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, সুইস ব্যাংকগুলোতে গচ্ছিত টাকার তথ্য-উপাত্ত পেতে হলে আগে তাদের সঙ্গে একটা ভালো সমঝোতা চুক্তি করতে হবে। সেই চুক্তির শর্তের মধ্যে এগুলোকে সুনির্দিষ্ট করতে পারলে তখন তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যেতে পারে।
সাবেক এই গভর্নর বলেন, টাকা ফেরত আনার বিষয়টি আরও কঠিন, তবে অসাধ্য নয়। এ জন্য প্রয়োজন হবে সুইস আইনে দক্ষ কোনো আইনজীবী প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা। বাংলাদেশ ব্যাংক, রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় এবং সরকারের যাদের এর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে, তাদের একত্রে সুনির্দিষ্টভাবে পদক্ষেপের প্রয়োজন। বড় একটি আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফিলিপাইনের ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসক ফারদিন্যান্দ মার্কোসের অর্থ উদ্ধার করতে বিশাল আইনিযজ্ঞ শেষ করতে হয়েছিল। ফলে সেটা বাংলাদেশকে মাথায় রেখেই এগোতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, সর্বশেষ চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউ উল্লেখ করেছে, সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) কর্তৃক প্রকাশিত ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড ২০১৩’ শীর্ষক বার্ষিক প্রতিবেদনটি সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়। তাতে বাংলাদেশিদেরও বিপুল পরিমাণ অর্থ সেখানে রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিএফআইইউ বলেছে, তাদের ধারণা, এর মধ্যে কোনো কোনো ব্যক্তি মানি লন্ডারিং বা অবৈধভাবে সেই অর্থও সুইস ব্যাংকে জমা রেখে থাকতে পারেন। সে কারণে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধের স্বার্থে বিস্তারিত তথ্য দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে সুইজারল্যান্ডের কাছে।
এর আগে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের বিপুল অঙ্কের টাকা জমা থাকার তথ্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশের পর গত ২৬ জুন বাংলাদেশ ব্যাংক পাচারকৃত অর্থের আদান-প্রদান বিষয়ে সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসএনবির সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তি করার আগ্রহ প্রকাশ করে চিঠি পাঠায়। গতকাল বুধবার পর্যন্ত এর জবাব মেলেনি।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও বিএফআইইউর দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক ম. মাহফুজুর রহমান প্রথম আলোকে জানান, ২৬ জুনে তাদের পাঠানো চিঠিটি ছিল একটা সমঝোতা চুক্তির আগ্রহ প্রকাশ করে। তিনি আরও বলেন, ‘এবার আমরা বিস্তারিত তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছি।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিএফআইইউর একটি সূত্র বলছে, ভারত অন্তত চার বছর ধরে চেষ্টা করছে তাদের দেশের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের যে অর্থ সুইস ব্যাংকগুলোতে রয়েছে, তার বিস্তারিত তথ্য জানতে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেসব তথ্য পায়নি। সংবাদপত্রে বিভিন্ন সময় কিছু ব্যক্তির অর্থ পাচারের তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলাদেশ থেকে বিআইএফইউ ইতিপূর্বে সুইজারল্যান্ডের এফআইইউর কাছে তাদের নাম উল্লেখ করে তথ্য চেয়েছিল। সেই তথ্যও পাওয়া যায়নি। এরও আগে বাংলাদেশে বিগত সামরিক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সুইস ব্যাংকগুলোতে টাকা রেখেছিলেন এমন প্রচার-প্রচারণা ছিল বহুদিন ধরে। তার কিছু তথ্য-উপাত্ত বিভিন্ন সময় সংবাদমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ বিষয়েও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা দেখা যায়নি।
বিভিন্ন দেশে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন প্রতিরোধ বিষয়ে স্থাপিত ফাইন্যান্সিয়াল