নানামুখী উদ্যোগেও ‘লাগামহীন’ কাঁচাবাজার
রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার ও সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থার নানা উদ্যোগের মধ্যেও রোজায় নিত্য পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আসছেনা।
রোজার আগেই সরকার বিশেষ কিছু পণ্যের রপ্তানি নিষিদ্ধ করে। তাছাড়া অন্যান্য বছরের মতো এবছরও টিসিবির মাধ্যমে কম দামে পণ্য সরবরাহ, দোকানে মূল্য তালিকা টানানো এবং বাজার তদারকিতে টিম গঠন করা হয়।
রমজান মাসে সরবরাহ ও দাম স্থিতিশীল রাখতে গত ২৫ জুন সরকার বেগুন, শশা, কাঁচা মরিচ, রসুন ও ধনেপাতা রপ্তানি বন্ধ করলেও এসব পণ্য বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে।
রমজানের প্রথম শুক্রবারে প্রতি কেজি বেগুন ৮০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত কেজি দরে বিক্রি হয়, যেখানে সপ্তাহ খানেক আগেও প্রতি কেজি গোল বেগুন ৫০ টাকায়, আর লম্বা বেগুন ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।
কাঁচাবাজারে শশার দাম এক সপ্তাহে বেড়েছে দ্বিগুণ। গত সপ্তাহে প্রতি কেজি শশা ২৫ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, তা এ সপ্তাহে বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে।
সপ্তাহজুড়েই কাঁচা মরিচের দামে ছিল ওঠানামা। শুক্রবার বিক্রি হয় ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে। গত সপ্তাহে এর দাম রাজধানীর কোনো কোনো বাজারে ৬৫ টাকা পর্যন্ত উঠেছিলো।
বাজারে আলু, রসুন ও আদার দামও আরেক দফা বেড়েছে। প্রতিকেজি আলু ২৫ থেকে ২৬ টাকা, রসুন কেজিপ্রতি ৫ টাকা বেড়ে ৮৫ টাকায় এবং প্রকারভেদে আদার দাম কেজি প্রতি ১০ থেকে ২০ টাকা বেড়ে ১৬০ থেকে ২৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া লেবু প্রতি হালি ১০ থেকে ১২ টাকা, আর ধনে পাতা প্রতি কেজি ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
পণ্যের মজুদ যথেষ্ট পরিমাণে থাকার কারণে রোজায় বাজার স্থিতিশীল থাকবে বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী ও ব্যবসায়ী নেতারা। কিন্তু রমজান শুরুর আগেই কাঁচাবাজারে বেশকিছু পণ্যের মূল্য কয়েকদফা বাড়ে। তখন এর পেছনে বৈরী আবহাওয়াকে দায়ী করেছিলেন ব্যবসায়ীরা।
এখন আবহাওয়া ভালো হওয়া সত্ত্বেও বাজারে ওইসব পণ্যের দাম কমেনি।
দাম বৃদ্ধি পাওয়া পণ্যের তালিকায় গত দুই সপ্তাহ ধরেই শীর্ষে রয়েছে পেঁয়াজ। বাংলাদেশের চাহিদার একটি বড়ো অংশ পূরণ হয় ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানি করে।
কিন্তু দেশটি ১৫ দিনের মাথায় দ্বিতীয় দফায় রপ্তানি মূল্য বাড়ানোয় রমজানের এই সময়ে বাংলাদেশে পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। নিজের বাজার সামাল দিতে পেঁয়াজের রপ্তানিমূল্য টনপ্রতি সর্বনিম্ন ৫০০ ডলার করেছে ভারত। আর সেই ধাক্কায় বাংলাদেশের বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দর উঠেছে ৪৫ টাকায়। ভারত পেঁয়াজের রপ্তানি মূল্য বাড়ানোর প্রথম দফায় কেজিতে ৫ টাকা আর দ্বিতীয় দফায় কেজিতে ১০ টাকা দাম বেড়েছে বাংলাদেশের বাজারে। ফলে ঢাকার বাজারে গত দুই সপ্তাহে কেজিতে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ১৫ টাকা।
এ বিষয়ে শ্যামবাজার কৃষিপণ্য আড়ৎ বণিক সমিতির সভাপতি হাজী মো. সাঈদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভারতে পেঁয়াজের দাম বাড়ার কারণে আমাদের বাজারে বাড়ছে। এটা বাড়বে। আমাদের সবাইকে এটা মানতেও হবে।
“কারণ বাংলাদেশের পেঁয়াজের চাহিদার প্রায় অর্ধেক যোগান হয় ভারত থেকে। অন্য কয়েকটি দেশ থেকে পেঁয়াজ আনা সম্ভব কিন্তু সেগুলো মানুষ খাবে না।”
তবে পেঁয়াজ ছাড়া অন্যান্য পণ্যের দাম বৃদ্ধির কোনো কারণ নেই বলে মনে করছেন তিনি। “অন্য যেসব মালামালের দামের কথা বলছেন সেগুলোর পাইকারি বাজার তো ঠিক আছে। খুচরা বাজারে দাম বাড়ছে বেশি। এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ কোনো পর্যায় থেকেই নেই। পাইকারি বাজারের মতো খুচরা বাজার মনিটরিং করা দরকার,” বলেন তিনি।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই প্রতিবছর রোজায় বাজার মনিটরিং সেল গঠন করে। এই সেল মূলতঃ পাইকারি ব্যবসায়ীদের বাজারে পণ্য সরবরাহের বিষয়টি দেখভাল করে।
সেলের প্রধান এফবিসিসিআইয়ের সহ-সভাপতি মো. হেলালউদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সব পণ্যের বাজার স্থিতিশীল রয়েছে। বেগুন, শশা আর পেঁয়াজের দাম একটু বেড়েছে।
“বেগুন, শশার দাম বাড়ার কারণ আমাদের ভোক্তাদের একসাথে বেশি পরিমাণে কেনা আর পেঁয়াজের দাম বাড়ছে ভারতের বাজারের কারণে।”
“তবে আশা করছি এটা ঠিক হয়ে যাবে,” বলেন হেলালউদ্দিন।
বাংলাদেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ২৩ লাখ টন বলে ধরা হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ১৯ লাখ ১৪ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদন হয়েছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ওই সময়ে আমদানি হয়েছিল ৫ লাখ টনের বেশি।
ঘাটতি মেটানোর একমাত্র উৎস ভারত। সেখানে কোনো কারণে পেঁয়াজ না পেলে আমদানিকারকরা মিয়ানমার, পাকিস্তান ও তুরস্কের দিকে হাত বাড়ান। চীন থেকেও মাঝেমধ্যে পেঁয়াজ আসে। সেগুলো আকারে অনেক বড়।
কিন্তু চীনা পেঁয়াজ ঝাঁঝহীন হওয়ায় তা বাংলাদেশিদের কাছে ততোটা পছন্দের নয়।
২০১০ সালে কয়েক দফায় ভারত পেঁয়াজের রপ্তানিমূল্য বাড়িয়েছিল। গত বছরও তিন দফায় রপ্তানিমূল্য বাড়িয়ে টনপ্রতি ১১৫০ ডলার করেছিলো দেশটি। অবশ্য গত বছর ভারত রপ্তানিমূল্য বাড়িয়েছিল রমজানের পর। ঈদ শেষ করে ঢাকায় ফেরা মানুষ বাজারে গিয়ে দেখতে পায় পেঁয়াজের কেজি ৬০ থেকে ৭০ টাকা হয়ে গেছে। পরে এর দাম আরো বেড়ে শেষ পর্যন্ত দেশি পেঁয়াজ ১২০ টাকা এবং ভারতীয় পেঁয়াজ ১০০ টাকা কেজিতে গিয়ে ঠেকে।
ভারত থেকে আনতে না পেরে তখন চীন, মিয়ানমার ও পাকিস্তান থেকে পেঁয়াজ আমদানি করেছিলেন ব্যবসায়ীরা।
এদিকে, টিসিবি সারা দেশে ১১৭টি ট্রাকে চিনি, খেজুর, সয়াবিন তেল, মসুর ডাল ও ছোলা বিক্রি করছে।
এবছর রমজানে সরকারের এই বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানটি প্রতিটি ট্রাকে ১ টন চিনি, ২০০ থেকে ৪০০ লিটার সয়াবিন তেল, ২০০ থেকে ৪০০ কেজি ছোলা, ২০০ থেকে ৪০০ কেজি মসুর ডাল এবং ৫০ থেকে ১০০ কেজি খেজুর বিক্রি করছে।
অবশ্য এসব পণ্যের মধ্যে খেজুর ছাড়া অন্য সব পণ্যের দাম খোলা বাজারেও স্থিতিশীল রয়েছে। খেজুরের দাম এক সপ্তাহের ব্যবধানে বিভিন্ন মান অনুযায়ী ২০ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
তবে বাজারে কমেছে খোলা সয়াবিন তেল ও পাম অয়েলের দাম। বর্তমানে খোলা সয়াবিন তেল ৯০ থেকে ৯৫ টাকা, আর পামঅয়েল লিটার প্রতি ৭৬ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
পরিদর্শনে যাচ্ছে এফবিসিসিআই
কাঁচাবাজারের পণ্যমূল্য বাড়ায় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই বাজার পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
শুক্রবার রাত ১১টায় রাজধানীর কারওয়ান বাজার পরিদর্শন করবে এফবিসিসিআই নেতৃত্বাধীন পরিদর্শন দল। এফবিসিসিআই’র সঙ্গে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও বাণিজ্য মন্ত্রনালয়ের প্রতিনিধিরা থাকবেন।
এ বিষয়ে এফবিসিসিআই সহ-সভাপতি মো. হেলালউদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা পাইকারী ও খুচরা বাজারের আসল চিত্রটা দেখতে চাই। কেন খুচরা বাজারে হঠাৎ হঠাৎ করে দাম বাড়ছে। কোনো ব্যবসায়ী কারসাজি করে পণ্য মূল্য বাড়ালে আমরা অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবো।”