বেপরোয়া পুলিশ বেসামাল ছাত্রলীগ
সিনিয়র রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ নারায়নগঞ্জে অপহরণের পর প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ ৭ খুনের ঘটনা জনসমক্ষে প্রকাশিত হওয়ার পর র্যাবের বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ড থেমে গেলেও বেপরোয়া এখন পুলিশ। থানায় ধরে এনে পিটিয়ে মারাসহ তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে সারা দেশে গত এক মাসে অন্তত: ৯ জনের প্রানহানি ঘটেছে। অস্ত্র ঠেকিয়ে পায়ে গুলি করারও অভিযোগ রয়েছে অসংখ্য। একই অবস্থা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগেরও। ৫ জানুয়ারীর এক তরফা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বেপরোয়া হয়ে ওঠে এই ছাত্র সংগঠনটি। এমনকি নিজ সংগঠনের মেধাবীছাত্রদের হত্যা, মুক্তিপনের দাবিতে অপহরণ, চাঁদাবাজি, টেন্ডার ছিনতাই, থানায় হামলা, পুলিশ-সাংবাদিক পেটানোসহ এমন কোন অনৈতিক কাজ নেই যা তারা করা থেকে বিরত আছেন।
দেশের বিভিন্ন থানা, পুলিশ ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত পুলিশ-ছাত্রলীগের অপরাধমূলক কর্মকান্ডের বিস্তারিত জানতে গিয়ে গত এক মাসে (১৫ জুন থেকে ১৫ জুলাই) পুলিশের হাতে সারাদেশে অন্তত: ৯ জনকে পিটিয়ে ও কথিত বন্ধুকযুদ্ধে হত্যা করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সুজন নামে এক জুট ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে আজ (বুধবার) সন্ধ্যায় গ্রেফতার হয়েছেন মিরপুর থানার এসআই জাহিদুর রহমান।
ছাত্রলীগের বিরুদ্ধেও মেধাবী ছাত্রদের হত্যা, মুক্তিপনের দাবিতে অপহরণ, চাঁদাবাজি, টেন্ডার ছিনতাই, থানায় হামলা, পুলিশ ও সাংবাদিক পেটানোসহ বিস্তর অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছে। দু’দিন আগে অপহরণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আটক রেখে মুক্তিপন আদায়ের চেষ্ট করা ছাড়াও সাংবাদিকদের পেটানোর অভিযোগে গতকাল বরখাস্ত হয়েছেন ঢাবির ১২ জন ছাত্র। এর আগে গত মাসেও একই অপরাধে বরখাস্ত হয়েছিলেন আরো ৭ জন ছাত্র। যশোরে প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মী রিয়াদ হত্যার অভিযোগে গতকাল মঙ্গলবার ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতিসহ ১৪ জনকে আসামি করে মামলা হয়েছে যশোর সদর থানায়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কারও করা হয়েছে তাদের। এছাড়া দু’সপ্তাহ আগে পল্টন মোরে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা এক ট্রাফিক পুলিশকে মেরে পোশাক ছিড়ে ফেলেন। ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সভাপতির সামনেই এ ঘটনা ঘটে।
রাজধানীর মিরপুর থানার এসআই জাহিদুর রহমানের বিরুদ্ধে মাহাবুবুর রহমান সুজন নামে এক জুট ব্যবসায়ীকে বাসা থেকে ধরে এনে পিটিয়ে হত্যা করার গুরুতর অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। গত ১২ জুলাই রাতে তিনি সুজনকে ধানমন্ডির শংকর এলাকা থেকে ধরে মিরপুর থানায় এনে তিনি পিটিয়ে হত্যা করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। নিহত সুজনের স্ত্রী জানায়, মিরপুর থানার এসআই জাহিদুর রহমান চাঁদার টাকা না পেয়ে থানার একটি কক্ষে সুজনকে পিটিয়ে হত্যা করেন। জাহিদকে ইতিমধ্যেই মিরপুর থানা থেকে প্রত্যাহারের পর বুধবার রাতে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এ বিষয়ে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর আগে মঙ্গলবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেন্সিক বিভাগের দাখিলকৃত রিপোর্টে সুজনের শরীরে প্রচুর আঘাতের চিহ্ন ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তার মৃত্যু নির্যাতনেই হয়েছে বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
আলোচিত মিরপুর থানার এই এসআইয়ের হাতে গত তিন মাসে তিন জন নিহত হয়েছেন। গত জানুয়ারি মাসে পল্লবী থানায় থাকাকালে জাভেদ নামে এক যুবককে ধরে পায়ে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলী করেন বলে অভিযোগ ওঠে। পা থেকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরনে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে জাভেদের মৃত্যু হয়। গত ফেব্রুয়ারী মাসে জনি নামের এক বিহারী যুবককে পল্লবী থানায় ধরে এনে পিটিয়ে হত্যা করেন বলে অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। পরে এই থানা থেকে তাকে ক্লোজ করে মিরপুর থানায় দেওয়া হয়।
গত ২৮ জুন মতিঝিলে ডিবির সঙ্গে কথিত বন্দুক যুদ্ধে জাকির হোসেন আকমল ও মো. রমজান নামে দুই ব্যক্তি নিহত হন। ডিবির দাবি তারা ছিনতাইকারী দলের সদস্য। তবে পরিবারের দাবি আকমল ও রমজান শ্রমিক লীগের সক্রিয় সদস্য ছিলেন।
অভিযোগ রয়েছে, গত দুই মাসে দেশের যশোর জেলায় কথিত ২৫টি বন্দুক যুদ্ধের ঘটনা ঘটে। এতে দু’জন নিহত হন। এছাড়াও ২৩ জন পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। ভুক্তভোগি পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের সবাইকেই ধরে কোন নির্জন এলাকায় নিয়ে পুলিশ গুলি করেছে। এগুলো নিয়ে আজ পর্যন্ত কোন তদন্ত কমিটিও করা হয়নি।
গত ১০ জুলাই রাতে ঝিনাদহে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুক যুদ্ধে আব্দুর রশিদ ও হযরত আলী নামে দুই ব্যক্তি নিহত হন। পেশায় তারা দু’জন ছিলেন কৃষক। তাদের পরিবারে দাবি বাড়ি থেকে তাদের ধরে নিয়ে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। এই ঘটনার পর দুই কৃষককে চরমপন্থি দলের সন্দেহভাজন সদস্য ছিল বলে পুলিশ অভিযোগ করেছে।
গত ৮ জুলাই মাদারীপুরের ডাসা থানার ওসিসহ চার পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, থানায় শাহিন নামে এক ব্যক্তিকে ধরে এনে রাতভর নির্যাতন চালানো হয়। এতে সকালে শাহিনের মুত্যু হয়। শাহিনের মা রেবা বেগম বাদি হয়ে মাদারীপুর আদালতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
গত ১৪ জুলাই সাতক্ষীরায় শওকত ও জাহাঙ্গীর নামে দুই ব্যক্তিকে আটকের পর চোখ বেঁধে পায়ে গুলি করার অভিযোগ উঠেছে সাতক্ষীরা সদর থানা পুলিশের বিরুদ্ধে। পুলিশের দাবি, অস্ত্র উদ্ধারে গেলে ডাকাত দলের কয়েকজন সদস্য তাদের ছিনতাইয়ের চেষ্টা করে। এ সময় পুলিশের গুলিতে তারা আহত হন। পরিবারে দাবি, তারা দুজনই নিরিহ। তাদের বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গুলি করা হয়েছে।
চট্রগ্রামের পটিয়া থানার এসআই কুতুব উদ্দিনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতা ফরিদুল আলমকে ক্রসফায়ারে দেয়ার হুমকির অভিযোগ উঠেছে। গতকাল (১৫ জুলাই) ফরিদ আলম এ বিষয়ে হুমকির অভিযোগ এনে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজিকে লিখিত অভিযোগ করেন।