নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অপরিহার্যতা
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার (Non-Party Caretaker Government) একটি রাজনৈতিক বাস্তবতা। রাজনৈতিক আন্দোলনের ফল। এর জন্মলগ্ন থেকেই কিন্তু এটিকে আইনি অথবা সাংবিধানিক বিতর্ক হিসাবে দেখা হয়েছে। ১৯৯৬ সালে এ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি রিট পিটিশন দাখিল করেন সাইয়িদ মশিউর রহমান (Petition No 1720 of 1996)।
বিচারপতি মোজাম্মেল হক এবং বিচারপতি এম এ মতিন সে আবেদন নাকচ করে রায় দিয়েছিলেন। রায়ে বলা হয়, “জাতীয় সংসদ ত্রয়োদশ সংশোধনী গ্রহণ করে কোনো অবৈধ কাজ করেনি। ফলে ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিরুদ্ধে আমরা কোনো যুক্তি দেখি না। [We find that no unconstitutional action was taken by the legislature and as such, we do not find any reason to interfere with the 13th Amendment Act ]
১৯৯৯ সালে আর একটি রিট পিটিশন (petition no 4112 of 1999) পেশ করা হয় সলিমুল্লাহ খান কর্তৃক। হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি জয়নুল আবেদিন, বিচারপতি আওলাদ আলী এবং বিচারপতি মীর্জা হুসেন হায়দার সমন্বয়ে গঠিত এক বৃহত্তর বেঞ্চ ২০০৪ সালের ৪ আগস্টে প্রদত্ত এক রায়ে সংবিধান সংশোধন (ত্রয়োদশ সংশোধনী) আইনে অনুমোদন দান করে রায় দিয়েছিলেন।
এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয় সাত বছর পরে, ২০১১ সালের ১ মার্চে। আপিলের সংক্ষিপ্ত রায় দেওয়া হয় ২০১১ সালের ১০ মে। এ রায়ে ত্রয়োদশ সংশোধনীকে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ৪:৩ ভোটে ‘সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক’ এবং তাই ‘অবৈধ ও অসাংবিধানিক’ বলে রায় দিয়েছেন। সংক্ষিপ্ত এ রায়ে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে দশম এবং একাদশ সংসদের সাধারণ নির্বাচন ত্রয়োদশ সংশোধনী অনুযায়ী হতে পারে। তবে এর সঙ্গে প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগের বিচারপতিদের না জড়ানো ভালো।
আপিল বিভাগের এ রায়ের পক্ষে তিনটি যুক্তিও প্রদর্শন করা হয়। এক, যদিও এ সংশোধনী অবৈধ, তথাপি রাজনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে তা আইনসম্মত (quod alias non est licitum, necessites licitum facit)| দুই, জনগণের নিরাপত্তা সংরক্ষণ করা হল যে কোনো প্রজাতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ আইন (‘Salus populi suprema lex)| তিন, প্রজাতন্ত্রের নিরাপত্তা রক্ষাই হল শ্রেষ্ঠ আইন (Salus republicae est suprema lex’-Safety of the republic is the supreme law)
অন্য কথায়, দশম এবং একাদশ জাতীয় সংসদ সংগঠনের জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা জনস্বার্থ ও জাতীয় স্বার্থে আপিল বিভাগের রায়ে নিষিদ্ধ করা হয়নি। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন জোট কালবিলম্ব না করে যে ত্রয়োদশ সংশোধনী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্দোলনের ফলেই সংবিধানের অংশ হয়েছিল ১৯৯৬ সালে, তা বাতিল করে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে।
তখন থেকেই তারা বলে চলেছে, ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত করে দ্রুতগতিতে নতুন সংবিধান মুদ্রিত হল এবং তা বাজারেও এল। লক্ষ্য একটি এবং তা এ যে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামনিশানা মুছে দেওয়া। তখনও কিন্তু ২০১১ সালে প্রকাশিত সংক্ষিপ্ত রায়ের পরিবর্তে পরিপূর্ণ রায় প্রকাশিত হয়নি।
ত্রয়োদশ সংশোধনী সম্পর্কে আপিল বিভাগে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় দেশের ৮ জন বিশিষ্ট আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি বা আদালতের পরামর্শদাতা বন্ধু মনোনীত করে তাদের মত নিয়েছিলেন। এ আটজনের মধ্যে সাতজনই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে মত দিয়েছিলেন। এমনকী, সংবিধান সংশোধন কমিটির চেয়ারম্যান এবং কো-চেয়ারম্যান সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও একাধিকবার বলেছেন যে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত করার কোনো ইচ্ছা নেই আমাদের।
সংবিধান সংশোধনের পূর্বে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং দেশের বিভিন্ন পেশার যে সকল বাছাই করা নাগরিকের সঙ্গে সংবিধান সংশোধন কমিটি বৈঠক করে, তাদেরও শতকরা নব্বইভাগ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার পক্ষে মতপ্রকাশ করেন বলে জানা যায়। দেশের সংবাদপত্রের বিশিষ্ট সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকেও সংবিধান সংশোধন কমিটি লাভ করে এমনি মত।
তারপরেও কেন মাননীয় প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক সংক্ষিপ্ত রায় প্রকাশের ষোল মাস পরে ২০১২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরে পূর্ণাঙ্গ বিভক্ত রায়ে স্বাক্ষর করলেন? তার লেখা পূর্ণাঙ্গ রায়ে স্বাক্ষর করেছেন বর্তমান প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি এস কে সিনহা এবং বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন।
অন্যদিকে বিচারপতি খায়রুল হকের রায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি ‘সাংবিধানিক অপরিহার্যতা’ উল্লেখপূর্বক ভিন্ন রায় লিখেছেন বিচারপতি আবদুল ওয়াহাব মিঞা। তার ব্যাখ্যার সঙ্গে ঐক্যমত পোষণ করেছেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। আইনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী এ রায় তাই বিচারপতি আবদুল ওয়াহাব মিঞা এবং বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার যৌথ রায় হিসাবেই পরিগণিত।
বিচারপতি ইমান আলী ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং ফলে অবৈধ কী না এ প্রশ্নে বিচারপতি আবদুল ওয়াহাব মিঞার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন। তিনি অবশ্য বলেছেন, এ পদ্ধতি ভবিষ্যতে অনুসরণ করা হবে কী না তা জাতীয় সংসদই ঠিক করবে।
বিচারপতি আবদুল ওয়াহাব মিঞা বিচারপতি খায়রুল হকের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে তার ১৭৮ পৃষ্ঠার রায়ে লিখেছেন, ‘‘ষষ্ঠ সংসদে গৃহীত ত্রয়োদশ সংশোধনীতে গণতন্ত্র, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ এবং সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ধ্বংস হয়নি। বরং ত্রয়োদশ সংশোধনী হল সাংবিধানিক অপরিহার্যতা।’’
১৯৯৬ সালের অরাজক পরিস্থিতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, গণতন্ত্রের ডুবন্ত নৌকা রক্ষা করেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই। ত্রয়োদশ সংশোধনীকে সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করা হলে নিশ্চিতভাবেই দেশে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে, যেমনটি ঘটেছিল ১৯৯৬ সালে। ফলে দেশের অর্থনীতি গতি হারাবে। গণতন্ত্র ও রাজনীতি বাধাগ্রস্থ হবে। দেশের অগ্রগতি স্তব্ধ হবে। গত তিনটি সাধারণ নির্বাচন এ ব্যবস্থা জনগণ ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেছে।
তিনি আরও বলেন, বিচারপতি খায়রুল হকের পূর্ণাঙ্গ রায় এর পুর্বে প্রদত্ত সংক্ষিপ্ত রায়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা বিচারপতি আবদুল ওয়াহাব মিঞার রায়ের সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত পোষণ করেন। বিচারপতি ইমান আলী ত্রয়োদশ সংশোধনীতে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো উপাদান পাননি। তিনি তার স্বতন্ত্র রায়ে লিখেছেন, ‘‘ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ অথবা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় এবং এর মাধ্যমে সংবিধানের কোনো মূল কাঠামোকে ধ্বংস করাও হয়নি।’’
২০০৭ সালের পরিস্থিতির উল্লেখ করে বিচারপতি ইমান আলী তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির ভবিষ্যত জনগণ দ্বারা নির্বাচিত জাতীয় সংসদের উপর ছেড়ে দিয়েছেন। তবে সংসদের প্রতি সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন এ বলে যে, ‘‘যে কোনো নতুন পদ্ধতি প্রবর্তন করা হোক না কেন, তাকে স্থায়ীভাবে কার্যকর হতে হলে অবশ্যই জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্যতা পেতে হবে।’’ আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণে আওয়ামী লীগের চাতুর্যপূর্ণ চালাকিটা ধরতে পেরে বিচারপতি ইমান আলী তার রায়ের মাধ্যমে পুরো বিতর্ক সংসদেই ফেরত দিয়েছেন।
সংক্ষেপে, আপিল বিভাগের সাতজন বিচারপতির মধ্যে তিনজন বিচারপতি খায়রুল হকের ব্যাখ্যার সঙ্গে সম্পূর্ণ দ্বিমত পোষণ করেন। তাদের মতে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার শুধু সংবিধানসম্মতই নয়, তা সাংবিধানিক অপরিহার্যতাও বটে। এক্ষেত্রে এটিও স্মরণযোগ্য যে, হাইকোর্ট বেঞ্চ এর পূর্বে ত্রয়োদশ সংশোধনীকে সংবিধানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বিবেচনা করেই বাদীর রিট খারিজ করেন।
বাদী সে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে বিষয়টি আপিল বিভাগ পর্যন্ত গড়ায়। সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক অতিউৎসাহী হয়ে মামলাটি অদৃশ্য কোনো কারণে কার্যতালিকায় নিয়ে আসেন এবং ‘অবসরগ্রহণের মাত্র সাত দিন আগে’ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে সংক্ষিপ্ত আদেশ প্রদান করেন।
সাধারণ কোনো ব্যক্তি কোনো ভুল করলে সে ভুলের মাশুল তাকেই অথবা কোনো কোনো সময় তার ঘনিষ্ঠজনদের দিতে হয়। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থেকে কেউ এমন করলে তার মাশুল দিতে হয় সমগ্র জাতিকে।
আজকে বাংলাদেশে ১৪ দলীয় জোট ও ১৮ দলীয় জোটের মধ্যে যে সাংঘর্ষিক অবস্থান এবং যার ফলে সমগ্র দেশে ভীষণ এক অনিশ্চয়তা এবং তীব্র বৈরিতার আবহাওয়া সৃষ্টি হয়েছে তার মূলে রয়েছে বিচারপতি খায়রুল হকের অবিমৃষ্যকারিতা, কোনো বিকল্প সৃষ্টি না করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অবসান এবং তাও বিভক্ত রায়ের মাধ্যমে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছিল পুরোপুরি রাজনৈতিক বাস্তবতা। এ রাজনৈতিক বাস্তবতাকে আইনি বিতর্কে পরিণত করা কোনোক্রমেই সমীচীন ছিল না।
তাছাড়াও, এ মামলার রায়ের বিষয়ে অনেকগুলি প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে। এক, ২০১১ সালের ১০ মে তারিখে যে সংক্ষিপ্ত রায় প্রদত্ত হয় তা আপিল বিভাগের সকল বিচারপতির সম্মিলিত সিদ্ধান্ত বলে মনে হয়। এটি ৪-৩ ভোটে বিভক্ত রায় বটে, কিন্তু কোনো বিচারপতির স্বতন্ত্র অবস্থান এতে প্রতিফলিত হয়নি। কিন্তু ২০১২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরে যখন পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হল, দীর্ঘ ষোল মাস পরে, তা কিন্তু ২০১১ সালের ১০ মে তারিখের সংক্ষিপ্ত রায় থেকে ভিন্ন। পূর্ণাঙ্গ রায়ে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ সংগঠনের জন্যে নির্বাচনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা বাদ দেওয়া হয়েছে।
সংক্ষিপ্ত রায়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে যেভাবে বলা হয়েছিল- ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ হলেও রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রয়োজনীয়তায় তা আইনসঙ্গত, জনগণের নিরাপত্তা এবং প্রজাতন্ত্রের নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন, পূর্ণাঙ্গ রায়ে তা অনুপস্থিত। তাছাড়া, পূর্ণাঙ্গ রায়ে তিনজন বিচারপতির স্বতন্ত্র অবস্থান সুস্পষ্ট। এ স্বতন্ত্র অবস্থানে তাদের বক্তব্যও প্রধান বিচারপতি ও তার সহযোগীদের বক্তব্য থেকে পুরোপুরি ভিন্ন।
এমনকী বিচারপতি আবদুল ওয়াহাব এবং বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা তাদের যৌথ রায়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ‘সাংবিধানিক অপরিহার্যতা’ বলেও উল্লেখ করেন। ত্রয়োদশ সংশোধনীতে তারা কোনো ত্রুটি দেখেননি।
পূর্ণাঙ্গ রায় সম্পর্কে আরেকটি প্রশ্ন আইন বিশেষজ্ঞদের দীর্ঘদিন ভাবাতে থাকবে। অবসরগ্রহণের পরে, বিশেষ করে দীর্ঘ ষোল মাস পরে, কোনো বিচারপতি কি কোনো রায়ে স্বাক্ষর দিতে পারেন? তিনি কি তখন শপথের আওতায় থাকেন?
সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ত্রয়োদশ সংশোধনী বিলুপ্তির জন্যে যে উৎসাহ প্রদর্শন করেছেন সে সম্পর্কেও দু’একটি কথা বলা প্রয়োজন। তিনি যখন প্রধান বিচারপতি হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন তিনি শপথ গ্রহণ করেন- “আমি বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিব; এবং আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন-অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিব।”
এ শপথের পরে তিনি কি পারেন যে “জনগণ প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক” সে জনগণ কর্তৃক প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের দ্বারা সংসদের গৃহীত কোনো সংশোধনীকে বাতিল করতে? তাছাড়া, আগেই উল্লিখিত হয়েছে, সংক্ষিপ্ত রায়টি লেখার ষোল মাস পরে এজলাসে উপস্থিত থেকে তিনি পূর্ণ রায়টির তার লিখিত অংশ কীভাবে প্রকাশ করলেন? তখন তো তার পূর্বে গৃহীত শপথের মধ্যে থাকার কথা নয়।
সংক্ষিপ্ত রায়ে প্রধান বিচারপতি নির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা নির্বাচন পরিচালনার কথা বলেননি। পূর্ণ রায়ে ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অবৈধ বলে শুধুমাত্র নির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা সংসদের নির্বাচনের কথা বলেছেন। কিন্তু নির্বাচনের সময় সংসদ ভেঙে দেওয়া হলে নির্বাচন পরিচালনার জন্যে নির্বাচিত ব্যক্তি কোথায় মিলবে? এজন্যে কী ফেরেশতাদের নিয়ে আসতে হবে? তারাও তো নির্বাচিত নন।
সংক্ষেপে, বিজ্ঞ বিচারপতিদের নিকট থেকে প্রত্যাশা করা হয়, তারা দেশের জন্যে, জনগণের জন্যে, বিশেষ করে দেশের নতুন গণতন্ত্রের জন্যে সহজ-সরল পন্থা বাতলাবেন যে কোনো সাংবিধানিক জটিলতায়। কিন্তু তা না করে তারা যে রাজনৈতিক বাস্তবতায় ত্রয়োদশ সংশোধনীর জন্ম হয়েছিল ১৯৯৬ সালে, সে সংশোধনী বাতিল করে দেশে সংঘাত ও সংঘর্ষের এক মারাত্মক পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছেন। এটি অপ্রত্যাশিত।
দেশে দুই বৃহৎ দলের মধ্যে অনাস্থা এবং অবিশ্বাসের মাত্রা এত উঁচু যে, নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো নির্দলীয় এবং নিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষ সৃষ্টি না করা হলে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কখনও সম্ভব হবে না। ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক’ নামটি সম্পর্কে আপত্তি থাকলে অন্য যে কোনো নামে তা সৃষ্টি করা বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক অপরিহার্যতা।
ড. এমাজউদ্দীন আহমদ : লেখক, কলামিস্ট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য।