মোবারকের মৃত্যুদণ্ড
সিনিয়র রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার মোগড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা মো. মোবারক হোসেনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে।
আজ সোমবার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ রায় দেন। এটি সাবেক কোনো আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার প্রথম রায়।
এক নম্বর অভিযোগে মোবারকের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এই অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ২২ আগস্ট মোবারক ও অন্য রাজাকারেরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া থানার টানমান্দাইল গ্রামের ২৬ জন ও জাঙ্গাইল গ্রামের সাতজনকে বাছাই করে তেরোঝুড়ি হাজতখানায় নিয়ে যান। ২৩ আগস্ট পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারেরা ওই ৩৩ জনকে দিয়ে গঙ্গাসাগর দীঘির পশ্চিম পাড়ে গুলি করে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়।
তিন নম্বর অভিযোগে মোবারককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। ওই অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ১১ নভেম্বর রাত আটটা-নয়টার দিকে মোবারক তাঁর সশস্ত্র রাজাকার সহযোগীদের নিয়ে ছাতিয়ান গ্রামের আবদুল খালেককে অপহরণ করে সুহিলপুর ইউনিয়ন পরিষদের রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যান ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করেন। ওই রাতেই খালেককে তিতাস নদীর পশ্চিম পাড়ে বাকাইল ঘাটে নিয়ে গুলি ও বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়।
২, ৪ ও ৫ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পেয়েছেন মোবারক। দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধকালে মোবারক ও অন্য স্বাধীনতাবিরোধীরা মিলে ‘আনন্দময়ী কালীবাড়ী’ নামের একটি হিন্দু মন্দিরের মূর্তি ভাঙচুর ও মালামাল লুটের পর এটি দখল করেন, পরে মন্দিরটির নাম রাখেন ‘রাজাকার মঞ্জিল’। ২৪ অক্টোবর মোবারক শিমরাইল গ্রামের আশুরঞ্জনকে অপহরণ করে আহত অবস্থায় চার দিন রাজাকার মঞ্জিলে আটকে রাখেন এবং ২৮ অক্টোবর তাঁকে কুড়লিয়া খালের পাড়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেন। চতুর্থ অভিযোগ হলো, একাত্তরের ২৪-২৫ নভেম্বর বেলা দুইটা-আড়াইটার দিকে মোবারকের নেতৃত্বে রাজাকারের একটি দল খড়মপুর গ্রামের খাদেম হোসেন খানকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার স্টেশন রোড থেকে অপহরণ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে স্থাপিত সেনাক্যাম্পে আটকে রেখে নির্যাতন করে। ৬ ডিসেম্বর অন্য কয়েকজন বন্দীর সঙ্গে তাঁকেও কুড়লিয়া খালের পাড়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। পঞ্চম অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের ২৮-২৯ নভেম্বর রাত ১১টার দিকে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে মোবারক খড়মপুর গ্রামের আবদুল মালেক ও আমিরপাড়া গ্রামের মো. সিরাজকে অপহরণ করেন। ৬ ডিসেম্বর সিরাজকে কুড়লিয়া খালের পাড়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে।
এই ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক। এটি ট্রাইব্যুনাল-১-এ ষষ্ঠ মামলার রায়।
রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন বলে জানিয়েছেন মোবারকের আইনজীবী তাজুল ইসলাম। তবে রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী সাহিদুর রহমান বলেন, ‘ন্যায়বিচার পেয়েছি।’
রায় ঘোষণা উপলক্ষে সকাল সাড়ে নয়টার দিকে মোবারক হোসেনকে ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় নেওয়া হয়।
মোগড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোবারকের বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম শেষে গত ২ জুন রায় অপেক্ষমাণ রাখা হয়। গত বছরের ২৩ এপ্রিল তাঁর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল। এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে তদন্ত কর্মকর্তাসহ ১২ জন সাক্ষ্য দেন। আসামিপক্ষে সাক্ষ্য দেন মোবারক ও তাঁর ছেলে। পরে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে মামলার কার্যক্রম শেষ হয়।
২০০৯ সালের ৩ মে মোবারকের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থানায় মামলা করেন একাত্তরের শহীদ আবদুল খালেকের মেয়ে খোদেজা বেগম৷ মোবারক হাইকোর্ট থেকে ছয় মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন পান৷ পরে স্থানীয় আদালত এই মামলা ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করেন। মোবারকের বিরুদ্ধে যখন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের তদন্ত চলছিল, তখন এই ট্রাইব্যুনাল তাঁকে জামিন দিয়েছিলেন। গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে৷ ১২ মার্চ ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ আমলে নিয়ে মোবারকের জামিন বাতিল করে তাঁকে কারাগারে পাঠান৷ ওই সময় থেকে তিনি কারাগারে আটক রয়েছেন।
অভিযোগ গঠনের আদেশ অনুসারে, মুক্তিযুদ্ধকালে মোবারক জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি জামায়াতের ইউনিয়ন পর্যায়ের সদস্য (রুকন) হন। একাত্তরে তিনি স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন।