নিষেধাজ্ঞা মনে করাতে এবার পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি
সিনিয়র রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, চট্টগ্রামঃ ছয় বছর ধরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা বহাল রয়েছে। কেউ তা মানেন না। ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে শিক্ষার্থী তাপস সরকার খুন হওয়ার এক সপ্তাহ পর গতকাল রোববার বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আবারও নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকার বিষয়টি জানাল কর্তৃপক্ষ।
বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ক্যাম্পাসে সভা-সমাবেশ, মিছিল, শোডাউন, মানববন্ধনসহ সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকবে। কেউ তা অমান্য করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুসারে ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা আগে থেকেই বলবৎ রয়েছে। ২০০৮ সালের নভেম্বরে ও ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিন্ডিকেটের পৃথক দুটি সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে এই নিষেধাজ্ঞা এখনো কার্যকর রয়েছে। এই দীর্ঘ ছয় বছরে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেনি কর্তৃপক্ষ।
তবে নতুন করে পুরোনো সিদ্ধান্তের কথা জানানো হলেও এটি কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সন্দিহান সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ছাত্রসংগঠনের নেতারা বলছেন, এর আগেও দুবার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।
এ বিষয়ে গতকাল রোববার রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী বলেন, যদিও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এটি কাম্য নয়, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে তো রাজনীতি রাজনীতির মতো চলছে না। তাই এটি কার্যকর করা জরুরি। মাঝখানে অঘোষিতভাবে এটি শিথিল হয়ে যায়। এবার থেকে হয়তো কঠোরভাবে এটি কার্যকর করা হবে। এটি কার্যকর থাকলে এসব অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটত না।
তবে এবার আর ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সিরাজ উদ দৌলাহ। তিনি বলেন, ‘আমরা যেহেতু পুনরায় সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তাই এটা কার্যকর করার চূড়ান্ত প্রচেষ্টা থাকবে আমাদের। পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতায় এটা আমরা বাস্তবায়ন করবই।’
ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে ১৪ ডিসেম্বর দুপুরে তাপস সরকার নিহত হওয়ার পর রাতে সিন্ডিকেটের জরুরি সভা হয়। ওই সভায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়নি বলে জানা যায়। এ বিষয়ে প্রক্টর বলেন, সেদিন সিন্ডিকেটে আলোচনা হয়নি তার কারণ, এ বিষয়ে আগে থেকেই সিদ্ধান্ত বলবৎ রয়েছে।
ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবির তাহলে কীভাবে ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালায়—এ প্রশ্নে প্রক্টর বলেন, মাঝখানে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি শিথিল হয়ে যায়। এখন সব পক্ষকে জানাতে পত্রিকায় নতুন করে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সিএফসি (চুজ ফ্রেন্ডস উইথ কেয়ার) ও ‘ক্যাম্পাস ছাত্রলীগ’ পক্ষের নেতা অমিত কুমার বসু বলেন, তাপস সরকার হত্যার বিচার চেয়ে শিক্ষার্থীরা অহিংস কর্মসূচি পালন করছে। কিন্তু প্রশাসন বিচারের প্রক্রিয়া রুদ্ধ করতে এই হঠকারী সিদ্ধান্ত নিল। এর মাধ্যমে হয়তো তাপস হত্যার বিচার হারিয়ে যাবে।’
ছাত্রলীগের ভিএক্স (ভার্সিটি এক্সপ্রেস) পক্ষের নেতা জালাল আহমেদ বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্তটি সময়োপযোগী। কিন্তু এটি দীর্ঘায়িত করা ভালো হবে না। কারণ এর মাধ্যমে প্রগতির চর্চা রুদ্ধ হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি আনোয়ার সাদাত জুনায়েদ বলেন, ‘অতীত বলছে, এই সিদ্ধান্ত শুধু আমাদের জন্যই কার্যকর থাকে। এটির মাধ্যমে মূলত দখলদার ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে।’
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সর্বপ্রথম রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে ২০০৮ সালের ১০ নভেম্বর। ওই দিন সিন্ডিকেটের ৪৫৮তম জরুরি সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। তবে এই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবির নিয়মিত রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করেছে।
এরপর ২০১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে সংঘর্ষে শিবিরের দুই নেতা নিহত হন। এর পরদিন সিন্ডিকেটের ৪৮০তম জরুরি সভায় আবারও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। কিন্তু এবারও সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়নি। সব শেষে ১৪ ডিসেম্বর তাপস সরকার নিহত হওয়ার পর গতকাল পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
নাম না প্রকাশের শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরকে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে অনুমতি দিয়ে সহযোগিতা করেছে কর্তৃপক্ষ। এ কারণেই একের পর এক সহিংস ঘটনা ঘটছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একটি সূত্র জানায়, কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েই গত বছরের ২৬ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের ভেতরে সমাবেশ করেছে ছাত্রশিবির। ২০১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারির সংঘর্ষ থেকে এ বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ক্যাম্পাসে অন্তত দশ-বারোবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ঝটিকা মিছিল করেছে শিবির। কিন্তু এসব ঘটনায় কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এটা লোক দেখানো। ক্যাম্পাসের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড রোখার অজুহাতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করার মানে হয় না। এর বদলে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার করলে সব সমস্যার সমাধান হতো।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, ছাত্রলীগের বিবদমান দুই পক্ষ ভিএক্স এবং সিএফসি ও ক্যাম্পাস ছাত্রলীগ গত ১৬ নভেম্বর ক্যম্পাসে শোডাউন করেছে। দুই পক্ষ নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী। এ ঘটনার এক দিন পর ১৮ নভেম্বর ছাত্রলীগের আরেক পক্ষ ক্যাম্পাসে শোডাউন করেছে। তারা নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারী।
তবে অন্য সংগঠনগুলো ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে চাইলে কর্তৃপক্ষ নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি ঢাল হিসেবে ব্যবহার করত বলে অভিযোগ রয়েছে। গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর ছাত্র ইউনিয়ন ক্যাম্পাসে তাদের ২৭তম সম্মেলন করার জন্য অনুমতি চায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে। কিন্তু তাদের অনুমতি দেয়নি কর্তৃপক্ষ। ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা ক্যাম্পাসে গত দুই বছরে কয়েকবার মিছিলের চেষ্টা করলে তাদেরও বাধা দেওয়া হয়েছে।