সর্বোচ্চ ৮০ হাজার, সর্বনিম্ন ৮২০০ টাকা বেতন
সিনিয়র রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য নতুন বেতনকাঠামোর সুপারিশ করেছে জাতীয় বেতন ও চাকরি কমিশন। এতে সর্বনিম্ন ৮ হাজার ২০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৮০ হাজার টাকা মূল বেতনের সুপারিশ করা হয়। বর্তমানে প্রায় ১৪ লাখ সরকারি চাকরিজীবী রয়েছেন।
কমিশনের চেয়ারম্যান বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন সব সদস্যকে নিয়ে গতকাল রোববার সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবেদন জমা দেন। কমিশন এবার ৬৭ দশমিক ৭ শতাংশ বেতন বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। এর আগে সাতবার বেতন বাড়ানো হয়। সপ্তম বারে ৬৩ শতাংশ বেতন বাড়ানো হয়েছিল।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবের জন্য এক লাখ টাকা এবং সিনিয়র সচিবদের ৮৮ হাজার টাকা নির্ধারিত বেতনের সুপারিশ করা হয়েছে। নতুন কাঠামোতে বর্তমানের ২০ ধাপের (গ্রেড) পরিবর্তে সুপারিশ করা হয়েছে ১৬ ধাপ। মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুখ্য সচিব ও সিনিয়র সচিবেরা অবশ্য এই ১৬ ধাপের বাইরে। এসব তথ্য জানিয়ে প্রতিবেদনের মূল সুপারিশগুলো সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেন মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। সুপারিশ তৈরিতে ছয় বছরের পুঞ্জীভূত মূল্যস্ফীতি, প্রতিবেশী দেশের বেতনাদি ও বেসরকারি খাতের সঙ্গে তুলনামূলক সামঞ্জস্য আনার চেষ্টা করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
ফরাসউদ্দিন বলেন, প্রথমবারের মতো চার সদস্যের পরিবর্তে ছয় সদস্যের পরিবার বিবেচনায় নিয়ে বেতনকাঠামোর সুপারিশ করা হয়েছে। নতুন কাঠামো কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহার্ঘ ভাতা বিলুপ্ত বলে গণ্য হবে।
সুপারিশ বাস্তবায়নে বর্তমানের তুলনায় ৬৩ দশমিক ৭ শতাংশ ব্যয় বাড়বে বলে জানিয়েছে কমিশন। চলতি অর্থবছরে বেতন-ভাতা খাতে ব্যয় ধরা আছে ২৮ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, পাঁচ বছর পর সরকারি চাকুরেদের বেতন বাড়ানোর সুপারিশ খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। প্রশ্ন উঠতে পারে বৃদ্ধির মাত্রা নিয়ে।
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এই বেতন-ভাতা বৃদ্ধির জন্য বাড়তি অর্থের জোগান দিতে বাজেটে ঘাটতির মাত্রা বেড়ে যায় কি না। আবার অন্যদিকে রাজস্ব সংগ্রহের প্রবৃদ্ধি গত অর্থবছরেও ভালো হয়নি, এবারও তেমন হচ্ছে না। ফলে বেতন-ভাতা দেওয়ার জন্য সরকারকে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণও নিতে হতে পারে। শঙ্কাটা আরও এই কারণে যে, সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা এরই মধ্যে পূরণ হয়ে গেছে।
কোন ধাপে কত: প্রথম ধাপে বেতনকাঠামো সুপারিশ করা হয়েছে ৮০ হাজার টাকা নির্ধারিত। বর্তমানে তা ৪০ হাজার টাকা। এই নির্ধারিতের মানে হচ্ছে অন্য সব ধাপের মতো এতেও বাড়িভাড়াসহ অন্য সব সুবিধা থাকবে। শুধু বছরে বছরে ইনক্রিমেন্টের কোনো ব্যাপার থাকবে না।
ফরাসউদ্দিন জানান, যাঁরা সচিব হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাঁদের নীতিনির্ধারণী ও সমন্বয়ের কাজে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হয়। এর স্বীকৃতিস্বরূপ ৫ শতাংশ হারে অর্থাৎ তাঁদের আরও চার হাজার টাকা অতিরিক্ত বেতনের সুপারিশ করা হয়।
দ্বিতীয় ধাপে মূল বেতনের সুপারিশ এসেছে ৭০ হাজার টাকা, বর্তমানে তা ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা। এভাবে তৃতীয় ধাপে বর্তমানের ২৯ হাজার টাকার পরিবর্তে ৬০ হাজার, চতুর্থ ধাপে বর্তমানের ২৫ হাজার ৭৫০ টাকার পরিবর্তে ৫২ হাজার, পঞ্চম ধাপে ২২ হাজার ২৫০ টাকার পরিবর্তে ৪৫ হাজার, ষষ্ঠতে ১৮ হাজার ৫০০ টাকার পরিবর্তে ৩৭ হাজার, সপ্তমে ১৫ হাজার টাকার পরিবর্তে ৩২ হাজার টাকা সুপারিশ করা হয়েছে।
বর্তমানে অষ্টম ধাপে ১২ হাজার ও নবম ধাপে ১১ হাজার টাকা মূল বেতন রয়েছে। এই দুটি মিলিয়ে করা হয়েছে অষ্টম ধাপ। এর জন্য সুপারিশ করা হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে এই সুপারিশটি করা হয়েছে বলে জানান ফরাসউদ্দিন।
এ ছাড়া নবম ধাপে ১৭ হাজার, দশমে আট হাজারের পরিবর্তে ১৩ হাজার এবং একাদশে ছয় হাজার ৪০০ টাকার পরিবর্তে ১১ হাজার ৫০০ টাকা সুপারিশ করা হয়েছে।
বর্তমানে দ্বাদশ ধাপে ৫ হাজার ৯০০ ও ত্রয়োদশ ধাপে ৫ হাজার ৫০০ টাকা মূল বেতন। এই দুটি মিলিয়ে নতুন দ্বাদশ ধাপের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে ১১ হাজার ৫০০ টাকা। এ ছাড়া ত্রয়োদশ ধাপে ১০ হাজার, চতুর্দশ ধাপে বর্তমানের ৫ হাজার ২০০ টাকার পরিবর্তে ৯ হাজার ৫০০ টাকা সুপারিশ করা হয়েছে।
বর্তমানের সপ্তদশ ধাপে মূল বেতন ৪ হাজার ৫০০ ও অষ্টাদশ ধাপে ৪ হাজার ৪০০ টাকা। এই দুটি মিলিয়ে নতুন কাঠামোতে করা হয়েছে পঞ্চদশ ধাপ, যার জন্য সুপারিশ নয় হাজার টাকা।
বর্তমানের ১৯তম ধাপের বেতন ৪ হাজার ২৫০ টাকা ও ২০তমের চার হাজার ১০০ টাকা। এই দুটি মিলিয়ে করা হয়েছে ষষ্ঠদশ ধাপ, যার মূল বেতন সুপারিশ করা হয়েছে ৮ হাজার ২০০ টাকা।
কিছু নতুন সুপারিশ: এবারের প্রতিবেদনে কিছু নতুন সুপারিশ এসেছে। মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন জানান, অন্যতম সুপারিশ হচ্ছে শ্রেণি বাদ দেওয়া। বর্তমানে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিজীবীরা কর্মকর্তা বলে পরিচিত। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিজীবীরা পরিচিত কর্মচারী হিসেবে। বাস্তবে যদিও সবাই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী।
ফরাসউদ্দিন জানান, সরকারি চাকরিতে বিভাজন সৃষ্টিকারী শ্রেণিকরণ রহিত করা হয়েছে। সুপারিশ করা হয়েছে উপনিবেশ আমলের শেষ শোষণযন্ত্র এফিশিয়েন্সি বারও (ইবি) তুলে দেওয়ার।
অনেক জটিলতা ও মামলা-মোকদ্দমার সৃষ্টি হয় সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেলের মাধ্যমে—এ কথা উল্লেখ করে চেয়ারম্যান তা বিলুপ্তির সুপারিশ করেছেন। তিনি বলেন, নতুন ব্যবস্থাটি হতে পারে পদোন্নতির মাধ্যমে পরবর্তী ধাপে ওঠা। পদোন্নতির জন্য ভীতি দূর করার চেষ্টা নিতে হবে। তিনি জানান, ‘পদোন্নতি হোক বা না হোক সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন ১৫ বছরে যাতে দ্বিগুণ হয়, সেই সুপারিশ করা হয়েছে।’
স্বেচ্ছা অবসরের বয়স বর্তমানের ২৫ বছর থেকে কমিয়ে ২০ বছর করার সুপারিশ করা হয় প্রতিবেদনে। এ ব্যাপারে মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, বর্তমানে পিআরএল (অবসর পরবর্তী ছুটি) পদ্ধতি অনেক বিভ্রান্তিকর। এর বদলে এলপিআর (অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটি) পদ্ধতিতে যাওয়া যেতে পারে। তাঁদের পেনশনের পরিমাণ বর্তমানের ৮০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯০ শতাংশে উন্নীত করতে সুপারিশ করা হয়েছে।
সরকারি চাকরিজীবীদের আবাসন সংকট দূর করতে কয়েকটি বিকল্প সুপারিশের কথা জানান ফরাসউদ্দিন। এর মধ্যে রয়েছে আবাসন নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ফ্ল্যাট তৈরি, যার হার হতে পারে ৬০: ৪০। এ ছাড়া ১০-২০ জন মিলে গড়ে তোলা দল জমি কিনে ফ্ল্যাট নির্মাণ করতে পারেন। এ ধরনের ক্ষেত্রে স্বল্প সুদে সবাইকে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিতে পারে সরকার।
প্রতিবেদনে একেবারেই নতুন সুপারিশ করা হয়েছে বিমা বিষয়ে। সরকারি চাকরিজীবীর নামে মাসে ৫০০ টাকা করে প্রিমিয়াম জমা হবে। এর মধ্যে ৪০০ টাকা যাবে স্বাস্থ্যবিমা খাতে, ১০০ টাকা যাবে জীবনবিমা তহবিলে। প্রিমিয়ামের টাকায় একটি আধুনিক মানের কার্ডিয়াক হাসপাতাল নির্মাণেরও সুপারিশ করা হয়েছে। বর্তমানে কর্মচারী কল্যাণ তহবিল নামে যে তহবিল রয়েছে, তা পুনর্গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। ফরাসউদ্দিন বলেন, বিমা, পেনশন ও কল্যাণ তহবিল ব্যবস্থাপনা নামে তিনটি আলাদা বিষয় করা যেতে পারে।
রাজধানীর দৈনিক বাংলায় থাকা সরকারি জমি থেকে ২০-২৫ কাঠা বিক্রি করে একটি ব্যাংক গঠনের সুপারিশ করা হয় প্রতিবেদনে। এই ব্যাংকের নাম হতে পারে ‘সমৃদ্ধির সোপান ব্যাংক’। ৪০০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের এই ব্যাংকের মাধ্যমে এক অঙ্কের সুদে ঋণ দেওয়া শুরু হতে পারে বলে মনে করেন ফরাসউদ্দিন।
লোকসানি স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে আলাদা বেতনকাঠামো সমর্থন করে না কমিশন। যেমন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ইত্যাদি খাত। এ কথা উল্লেখ করে কমিশন চেয়ারম্যান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য আলাদা বেতনকাঠামো সরকার চাইলে করতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে জাতীয় বেতনকাঠামোর ধাপের সমান ধাপ এই আলাদা বেতনকাঠামোর ক্ষেত্রেও থাকা বাঞ্ছনীয়। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন সাধারণের তুলনায় ছয় মাস পর কার্যকরের সুপারিশ করেছে কমিশন। চেয়ারম্যান বলেন, জটিলতা থাকায় তাঁদের বেতনকাঠামো মূল্যায়ন করতে তুলনামূলক সময় বেশি লাগবে।
সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত রাখা হয়েছে ১ দশমিক ৯০৭৬। আগের কয়েকটি কমিশনও একই অনুপাতের সুপারিশ করেছিল। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত পুঞ্জীভূত মূল্যস্ফীতির পরিমাণ ৬৩ শতাংশ। আর এ সময়ে দুই লাখ লোক সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়েছেন বলে জানান চেয়ারম্যান। সবশেষে তিনি একটি স্থায়ী বেতন ও চাকরি কমিশন স্থাপনের সুপারিশ করেন।
অর্থমন্ত্রী: প্রতিবেদন পাওয়ার পর অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এ পর্যন্ত যা শুনলাম, মনে হয় ভালোই হবে প্রতিবেদনটি। মাত্র তো পেলাম। আমরা এখন এটি পর্যালোচনা করব। এ জন্য একটি কমিটি করা হবে। মোটা দাগে কিছু বিষয় ঠিক করে (ব্রড গাইডলাইন) বাস্তবায়ন করব পর্যায়ক্রমে। আমাদের ইচ্ছেটা হলো আগামী বছরের ১ জুলাই থেকে প্রতিবেদনের সুপারিশ কার্যকর করা।’
সুপারিশ বাস্তবায়নের অর্থ কোথা থেকে আসবে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বাস্তবায়নের জন্য আমরা বাজেটেই বরাদ্দ রেখেছি। চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।’ এ ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী বলেন, ২৮ বছরে বাজেটের আকার যতটুকু বেড়েছে, ঠিক ততটুকু বেড়েছে গত পাঁচ বছরেই। সুতরাং সরকারের হাতে অর্থ আছে। মূল্যস্ফীতি বাড়বে কিনা জানতে চাইলে মুহিত বলেন, ‘না। কোনোভাবেই না (নো, অ্যাবসলিউটলি নো)।’
এ সময় অর্থসচিব মাহবুব আহমেদকে বিষয়টি সাংবাদিকদের বুঝিয়ে বলতে বলেন অর্থমন্ত্রী। সচিব বলেন, সুপারিশ বাস্তবায়ন করলে মূল্যস্ফীতির কোনো সম্ভাবনা নেই। এমনকি এই সুপারিশ আগে বাস্তবায়ন করলেও কোনো সমস্যা ছিল না।
আগামী দিনের অর্থনীতি হবে আলাদা ধরনের অর্থনীতি—এমন মন্তব্য করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সেই অর্থনীতির জন্য দরকার একটি আলাদা ধরনের প্রশাসন, একটি স্যাটিসফায়েড (সন্তুষ্ট) প্রশাসন। আমরা সেভাবেই এগোচ্ছি।’
মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বেতন বৃদ্ধির প্রসঙ্গ উঠলেই ব্যবসায়ীরা জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেন। আবার বেসরকারি খাতেও একটা চাপ তৈরি হয়। তখন মূল্যস্ফীতি বাড়ে। তবে এবারের বেতন বৃদ্ধির সুপারিশে তত না-ও বাড়তে পারে, সরকার যদি ব্যবসায়ীদের অহেতুক দাম বৃদ্ধির প্রবণতাটা দক্ষতার সঙ্গে নজরদারিতে রাখে।