টুকরো টুকরো স্বপ্ন পুড়ে ছাই
সিনিয়র রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ ‘মাইয়্যাডা ঘুমে ছিল। কম্বল গায়ে দিয়া ঘরের দরজা একটু আলগা কইরা বড় মাইয়্যারে ইশকুলে নেওয়ার লাইগ্যা বাইর হই। পথেই শুনি আগুন লাগছে। মাইনষে আমারে ঘরে ঢুকবার দেয় না। আমার মাইয়্যা তো কম্বল মুড়ি দিয়া ঘুমাইতাছে। আগুনের তাপে মনে হয় আরো ওম পাইছিল। কেউ আমার বাচ্চাডারে বাঁচাইলো না। না জানি কত কষ্ট হইছে। আমার বাচ্চারে আমার কুলে আইন্যা দেন। আমি আর কিছু চাই না।’
এভাবেই বিলাপ করছিলেন আকলিমা। অনেক খোঁজার পরে সাড়ে তিন বছরের মেয়ে ফাতেমাকে যখন ফিরে পেলেন, তখন তাকে আর চেনা যায় না। পুড়ে ঝলসে গেছে সে। লাশ কি না, তাও বোঝা যায় না। একটি কাপড়ে পেঁচিয়ে ফাতেমার রিকশাচালক বাবা মেয়েকে বুকে ধরে রেখেছিলেন।
আজ রোববার মোহাম্মদপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী রোডে জাফরাবাদ এলাকায় পুলপাড়, বটতলা বস্তি হিসেবে পরিচিত বস্তিটিতে সকাল আটটার দিকে আগুন লাগে। এই আগুনেই ফাতেমা নামের শিশুটি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আকলিমা বলছিলেন, ‘আমার মাইয়্যা আমারে মা কইয়া ডাহে না ক্যান?’
এখানে বসবাসকারী নিম্নবিত্ত মানুষের টুকরো টুকরো স্বপ্নগুলোও পুড়ে ছাই। ফলে অনেকে আকলিমাকে সান্ত্বনা দিয়েই ছুটছেন নিজের পুড়ে যাওয়া ঘরটির কাছে। ফায়ার সার্ভিস পানি দিয়ে আগুন নিভিয়েছে। চালের পুড়ে যাওয়া অবশিষ্ট টিন স্তূপ করে রাখা। দুপুর পর্যন্ত থেমে থেমে ধোঁয়ার কুণ্ডলি। সেই স্তূপের নিচে থেকেই কেউ ট্রাংক বের করছেন। কেউ বা পুড়ে যাওয়া সেলাই মেশিন। থালা, বাটি যদি কিছু পাওয়া যায় তারও চেষ্টা কারও কারও। এখানে বসবাসকারীরা কেউ বাসাবাড়িতে বুয়া হিসেবে কাজ করেন। কেউ পোশাক কারখানার শ্রমিক। কেউ ছিলেন পিঠা ব্যবসায়ী। বলতে গেলে সবাই ছিলেন নিম্নবিত্ত। ফলে তাঁদের খুব বেশি বড় স্বপ্ন ছিল না। টুকরো টুকরো স্বপ্ন দেখছিলেন। ছেলেমেয়েদের স্কুল বা মাদ্রাসায় পড়াচ্ছিলেন। কিছু কিছু সঞ্চয়ও করছিলেন। সকালে বেশির ভাগ লোক কাজের উদ্দেশে বাইরে চলে যাওয়ায় আহত বা নিহত হওয়ার ঘটনা কম ঘটেছে।
একেক ব্যবস্থাপকের অধীনে ২৫ থেকে ৩০টি ঘর। সেই ধরনের একজন ব্যবস্থাপক কুলসুম। তিনি জানালেন, তাঁর ঘরসহ প্রায় ৭৫টি ঘর পুড়ে গেছে। তিনিও মেয়েকে মাদ্রাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন। ঘরে কেউ ছিল না। তবে এক ঘরের সংসারে আলমারি, ফ্রিজসহ জিনিস তো কম ছিল না। এখন সব শেষ। কুলসুম এবং সেখানে বসবাসকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ইট, বাঁশ এবং টিন দিয়ে বানানো স্থাপনাগুলো দোতলা এমনকি তিনতলা পর্যন্ত করা হয়েছিল। এক হিসাব অনুযায়ী নিচতলায় ৪২টি এবং ওপরের তালায় ৪৪টি ঘর ছিল। এতে প্রায় ৫০০ বা তার বেশি পরিবার বাস করত। একেক ঘরের ভাড়া ছিল আড়াই হাজার টাকা বা তার বেশি। অনেকে সেখানেই মুদির দোকান দিয়েছিলেন। তাঁদের ঘর এবং দোকান দুটোই পুড়ে গেছে।
পেশায় টাইলস মিস্ত্রি ফয়সাল একা বসে বিলাপ করছিলেন। তিনি বলেন, ‘ঘরে ১২ হাজারের বেশি টাকা ছিল। সকালে কাজে গেছিলাম। তারপর আইস্যা দেখি শেষ। চিন্তা করতাছি খাব কী, থাকব কই।’
পোশাকশ্রমিক নাজমা পুড়ে যাওয়া ট্রাংক থেকে অনেক কষ্টে জমানো ৪০ হাজার টাকা খুঁজছিলেন। যখন পেলেন, তখন আর সেই টাকার কোনো দাম নেই। ৫০০ টাকা নোটগুলো আবছা দেখা গেল শুধু। একজন জানালেন, বের হওয়ার সময় ছোট সাদাকালো টেলিভিশনটা তিনি শুধু বের করতে পেরেছিলেন।
সদ্য কৈশোর পার হওয়া চায়নার মুখে এখন আর কোনো উচ্ছলতা নেই। বলল, গতকালই পোশাক কারখানা থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা বেতন পেয়েছিল। আগুন লাগার খবর শুনে শুধু নিজের জানটুকু নিয়ে বের হয়েছে।
মুদির দোকানের মালিক আবুল কালাম পুড়ে যাওয়া দোকানের সামনে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। এলাকায় তাঁর দোকানই একটু বড় ছিল। তিনি জানালেন, দোকানের লাখ লাখ টাকার জিনিস পুড়ে গেছে। দোকানে ৫০ হাজার টাকাও ছিল। শুধু দোকান নয়, তাঁর ঘরও পুড়ে ছাই।
অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের তালিকায় নিজেদের নাম রাখার জন্য ছুটছেন হুমায়ুন কবীর, শামসুন নাহার, নুরুন নাহার, নূর ইসলাম, হাসনা বানু, শাহিদা, আবদুল মজিদসহ আরো অনেকেই। ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে যে সাহায্য পাবেন, সেটুকুই ভরসা তাঁদের। ফলে গণমাধ্যমকর্মীসহ যাকে কাছে পাচ্ছেন, তাঁকেই ধরছেন।
সকাল থেকেই এলাকায় ফায়ার সার্ভিস, র্যাব, পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। উৎসুক জনতার ঢল নামে পুরো এলাকায়। কান্না, আহাজারি পুরো এলাকায়। ক্ষতিগ্রস্তরা শুধু আঙুল তুলে দেখাতে পারছেন ঠিক কোন জায়গায় তাঁর ঘরটি ছিল।
বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন) এ কে এম শাকিল নেওয়াজ দাবি করেন, আগুন লাগার কারণ এবং এ পর্যন্ত কত ক্ষতি হলো, তা তদন্ত সাপেক্ষে বলা যাবে। পুড়ে যাওয়া একটি বস্তু পাওয়া গেছে। সেটিই বাচ্চার লাশ কিনা—যাচাই করে দেখা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে প্রায় ৫০০ পরিবার এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এলাকায় দেখা গেল, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করছেন। আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড সেক্রেটারি আজিজুল ইসলামের ভাষ্য, ঘটনার পরপর স্থানীয় সাংসদ জাহাঙ্গীর কবির নানক দেখতে এসেছিলেন। তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করতে পাঠিয়েছেন।
দুপুরের দিকে এলাকা ছাড়ার সময় দেখা গেল টেবিল সাজিয়ে একদল তরুণ ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সাহায্য তুলছেন। তবে ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন, সবাই সাহায্য পাবে না। পেলেও তা দিয়ে তাঁদের পক্ষে আবার ঘুরে দাঁড়ানোও সম্ভব না। স্বপ্ন পূরণ তো অনেক দূরের কথা।