চিকিৎসকের পরামর্শ ফি নিয়ে যথেচ্ছাচার চলছে
আজমী আনোয়ার, সিনিয়র রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ রাজধানীতে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের পরামর্শ ফি আদায়ের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বছর কয়েক আগে পরামর্শ ফি নির্ধারণের সুপারিশ করলেও তা কেউ মানছেন না। এ নিয়ে যথেচ্ছাচার চলছে বলে চিকিৎসকরাই স্বীকার করেছেন।
এ নিয়ে বিভিন্ন সময় আলোচনা হলেও শেষ পর্যন্ত সরকার সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা দেয়নি। ফলে পরামর্শ ফি নির্ধারণের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের পরামর্শ কার্যত কাজে আসছে না।
রাজধানীর ব্যয়বহুল, মধ্যম সারি ও মধ্যবিত্তরা চিকিৎসার জন্য যায়—এমন কয়েকটি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চিকিৎসকদের পরামর্শক ফির মধ্যেই পাঁচগুণ পর্যন্ত কম-বেশি আছে। অনেক স্বনামধন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চেয়ে তাঁদের ছাত্র বা ছাত্রের ছাত্রদের পরামর্শ ফি বেশি। হাসপাতাল ভেদে একই চিকিৎসকদের পরামর্শ ফিও আলাদা।
বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব এ বি এম হারুন নিজেই স্বীকার করেছেন এ ক্ষেত্রে যথেচ্ছাচার চলছে। গতকাল মঙ্গলবার তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বছর কয়েক আগে অধ্যাপকদের পরামর্শ ফি ৬০০ টাকা এবং সহযোগী ও সহকারী অধ্যাপকদের পরামর্শ ফি ৫০০ টাকা মধ্যে নির্ধারণের সুপারিশ করেছিল। তবে অনেকেই এই নির্দেশনা মানছেন না। জনগণের সাধ্যের মধ্যে যেন পরামর্শ ফি ও অন্যান্য সেবা থাকে, সেই ব্যাপারে অ্যাসোসিয়েশন মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছে বলে তিনি জানান।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) শামিউল ইসলাম বলেন, সরকার খুব শিগগিরই বেসরকারি চিকিৎসা সেবা আইন করতে যাচ্ছে। এ আইনে এ বিষয়গুলো দেখা হবে।
তবে বেসরকারি চিকিৎসা সেবা আইন-২০১৪-এর খসড়া পড়ে দেখা গেছে, এ আইনে এমন কিছু নেই যাতে করে এই সমস্যাগুলোর সুরাহা হবে।
গত ১৪ জানুয়ারি স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ জাতীয় স্বাস্থ্য হিসাব ২০০৭-২০১২ প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশে এখন স্বাস্থ্যখাতে ব্যক্তির ব্যয় বেশি, সরকারের কম। যত টাকা এ খাতে খরচ হয়, তার ৬৩ দশমিক ৩ শতাংশ ব্যক্তির পকেট থেকে যায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন এ বি এম আবদুল্লাহ দুটি বেসরকারি হাসপাতালে ব্যক্তিগতভাবে রোগী দেখেন। তিনি পরামর্শ ফি নেন ৩০০ টাকা। তিনি যে হাসপাতালে রোগী দেখেন, একই হাসপাতালে তাঁর বিভাগের এক চিকিৎসকের পরামর্শ ফি এক হাজার টাকা। ওই একই বিষয়ে ঢাকার ব্যয়বহুল তিনটি হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ফি ১৫০০ টাকা পর্যন্ত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে একবারই ১৯৮২ সালে এসব বিষয় নিরসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। দ্য মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিস (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্স, ১৯৮২ নামে একটি অধ্যাদেশও জারি হয়েছিল। ওই অধ্যাদেশে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সমমর্যাদার চিকিৎসকদের পরামর্শ ফি প্রথম দফায় কত, দ্বিতীয় ও পরের প্রতিটি সাক্ষাতে কত হবে সে সম্পর্কে উল্লেখ ছিল। সে সময় প্রথম সাক্ষাতে চিকিৎসকের পরামর্শ ফি নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪০ টাকা। এ ছাড়া সহকারী অধ্যাপক, সিভিল সার্জন ও সমমর্যাদার চিকিৎসকের পরামর্শ ফি ও নিবন্ধিত চিকিৎসকদের ফি কত হবে সে সম্পর্কেও নির্দেশনা ছিল। নির্দেশনা ছিল বড়, মাঝারি ও ছোটো অস্ত্রোপচারের ব্যয় কত হবে, সে সম্পর্কেও। তবে চিকিৎসকদের বিরোধিতায় কখনই অধ্যাদেশটিকে আইন করা যায়নি, এমনকি বাস্তবায়নও করা যায়নি। সে সময় চিকিৎসক নেতারা যে যুক্তিতে বিরোধিতা করেছিলেন, এখনও তাঁরা একই যুক্তি দিচ্ছেন।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব এম ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘সরকার যদি উকিল, প্রকৌশলী সবার ফি বেঁধে দেয়; তাহলে চিকিৎসকদের ফিও বেঁধে দেওয়ার কথা আসতে পারে। শুধু চিকিৎসকদের ফি বেঁধে দেওয়াটা অবমাননাকর।’