ঢাকা দক্ষিণে মাঠে না থেকেও ফল–নির্ধারক হয়ে উঠতে পারেন যারা
মেহেদী আজাদ মাসুম, সিনিয়র রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ মাঠে না থেকেও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আলোচনায় আছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুই নেতা। তাঁরা হলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা এবং আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও স্বতন্ত্র সাংসদ হাজি সেলিম। দল সমর্থিত প্রার্থীদের জয়-পরাজয়ে এই দুজনের নেপথ্য ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। ঢাকা সিটি করপোরেশন দক্ষিণে এই দুই নেতার ব্যক্তিগত প্রভাব রয়েছে।
এর মধ্যে হাজি সেলিম নিজে দক্ষিণে মেয়র পদে মনোনয়ন নিয়েছিলেন। কিন্তু দলের সায় না থাকায় শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন জমা দিতে পারেননি। অন্যদিকে খোকা নিজে নির্বাচনের ইচ্ছা প্রকাশ না করলেও তাঁর অনুসারী হিসেবে পরিচিত বিএনপির অর্থবিষয়ক সম্পাদক এম এ সালাম প্রার্থী হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত দলের সিদ্ধান্তে তিনি মনোনয়ন প্রত্যাহার করেন। সেখানে দলীয় সমর্থন পেয়েছেন মহানগরের বিএনপির রাজনীতিতে দীর্ঘদিন থেকে খোকার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পরিচিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস।
মেয়র পদে নির্বাচন করতে সংসদ সদস্যপদ ছাড়তে গিয়ে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার অভিযোগও করেছিলেন হাজি সেলিম। জাতীয় সংসদের অধিবেশনে প্রশ্নোত্তর পর্বে সম্পূরক প্রশ্ন করতে গিয়ে হাজি সেলিম হাসতে হাসতে বলেন, ‘হায় রে কপাল মন্দ, চোখ থাকিতে অন্ধ। মাননীয় স্পিকার, আপনি যদি আমার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করতেন, তাহলে আমি এখানে থাকতাম না। ঢাকা দক্ষিণে থাকতাম।’ এ সময় স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী জানতে চান, ‘মাননীয় সংসদ সদস্য, আপনার পদত্যাগপত্রটি কোথায়? ’ সেলিমের জবাব, ‘আপনার কাছে’। স্পিকার আবার জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনার পদত্যাগপত্রটি কোথায়? ’ সেলিম বলেন, ‘আপনার কাছেই দিয়েছিলাম। ছিঁড়ে ফেলেছে।’
ঢাকা দক্ষিণে বিশেষত লালবাগসহ পুরান ঢাকায় হাজি সেলিমের ব্যক্তিগত ভালো প্রভাব রয়েছে। গত সংসদ নির্বাচনে তিনি ঢাকা-০৭ আসনে (লালবাগ) আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী মোস্তফা জালাল মহিউদ্দীনকে হারান। একতরফা ওই নির্বাচনে হাজি সেলিম পেয়েছিলেন ৪২ হাজার ৭২৮ ভোট। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের প্রার্থী পান ৩০ হাজার ৭৩৩ ভোট।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নিজে প্রার্থী হতে না পেরে হাজি সেলিম এখনো হতাশ। তিনি আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী সাঈদ খোকনের জন্য কতটুকু কাজ করছেন তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। অবশ্য দলীয় ফোরামে হাজি সেলিম আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী সাঈদ খোকনের পক্ষে কাজ করার সম্মতি দিয়েছেন। এ মাসের (এপ্রিল) শুরুতে এক শুক্রবারে দুজনে একসঙ্গে খাবারও খেয়েছেন। তবে ঢাকা দক্ষিণে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর জন্য কাজ করছেন এমন কয়েকজন জানান, এরপর থেকে হাজি সেলিম সেভাবে আর মাঠে নেই। তিনি অনেকটা চুপচাপ আছেন। তাঁর অনুসারীদের অনেকে মাঠে আছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হাজি সেলিম কী করেন তা দেখার বিষয়। তিনি বর্তমানে দেশের বাইরে থাকায় তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
অন্যদিকে বিএনপির ঢাকা মহানগরের সাবেক আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকা ও বর্তমান আহ্বায়ক মির্জা আব্বাসের দ্বন্দ্ব বেশ পুরোনো। ২০১৩ সালের আন্দোলনে ঢাকায় ব্যর্থতার জন্য মির্জা আব্বাস ও তাঁর অনুসারীরা সরাসরি তখন খোকাকে দায়ী করেছিলেন। পরে খোকার নেতৃত্বাধীন কমিটি ভেঙে আব্বাসকে আহ্বায়ক করা হয়। খোকার সমর্থকদের অভিযোগ, আব্বাস তখন থেকে মহানগরে নিজের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন। উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মেয়র প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়ার পর কাউন্সিলর প্রার্থীদের সমর্থন দেওয়া নিয়ে খোকার অনুসারীরা ক্ষুব্ধ। তাঁদের অভিযোগ, মির্জা আব্বাসের অনুসারীদের নির্বাচনে সুযোগ করে দিতে গিয়ে কাউন্সিলর পদে ‘অযোগ্যদের’ বিএনপির সমর্থন দেওয়া হয়েছে। তাঁদের দাবি, দুই সিটিতে ৯৩টির কাউন্সিলর আসনের মধ্যে এবার খোকার অনুসারীরা ২৮টিতে দলীয় সমর্থন পেয়েছেন। বাকিগুলোতে মির্জা আব্বাসের পছন্দের লোকদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। ঢাকায় খোকার প্রভাব কমাতে এমনটা করা হয়েছে বলে তাঁদের অভিযোগ। খোকার অনুসারী হিসেবে পরিচিত কয়েকজন কাউন্সিলর পদ থেকে সরেও দাঁড়িয়েছেন।
দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগ বিএনপির ঢাকা মহানগরের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন সাদেক হোসেন খোকা। দলের আহ্বায়ক থাকার পাশাপাশি ছিলেন অবিভক্ত ঢাকার মেয়র। ঢাকার ওয়ার্ডগুলোতে এর আগে বিএনপি সমর্থিত যেসব কাউন্সিলর ছিলেন তার বেশিরভাগই খোকার সমর্থক। ওয়ার্ড কমিটিগুলোও বেশিরভাগ ছিল খোকার সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণে। সে হিসেবে খোকার একটি ভালো প্রভাব রয়েছে দক্ষিণে। এখানে দল সমর্থিত প্রার্থী খোকার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পরিচিত মির্জা আব্বাস। খোকা লম্বা সময় ধরে দেশের বাইরে আছেন। কিন্তু বাইরে থেকেও তিনি দেশের রাজনীতিতে সক্রিয় বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। এ অবস্থায় খোকার সমর্থকেরা শেষ পর্যন্ত মির্জা আব্বাসের জন্য কতটুকু কাজ করবেন তা প্রশ্ন সাপেক্ষ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাস গতকাল রোববার অবশ্য দাবি করেন, বিএনপিতে সাদেক হোসেন খোকা-মির্জা আব্বাস গ্রুপ বলে কিছু নেই। এ দলে তাঁদের কোনো অনুসারীও নেই। এ দলে সবাই জিয়াউর রহমানের অনুসারী। তিনি বলেন, ‘সাবেক কমিশনার যাঁরা, তাঁদের অনেকেই প্রার্থী। তাঁরা মামলার কারণে আত্মগোপনে রয়েছেন। নিজেদের প্রচার করতে পারছেন না। তবে আমি তাঁদের পক্ষে, তাঁরা আমাদের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন। এখানে কোনো ভেদাভেদ নেই।’