জাল ভোটের সহযোগী পুলিশ
আজমী আনোয়ার, সিনিয়র রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাল ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগীর ভূমিকায় ছিল পুলিশ। পুলিশ নিজে জাল ভোটে সহায়তা করেছে, কোথাও সরাসরি জাল ভোট দিয়েছে, আবার জাল ভোট প্রতিরোধে বাধাও দিয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার ভোট গ্রহণ চলার সময় ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার ২০টির বেশি কেন্দ্র ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে।
তবে এসব অভিযোগের কথা মানতে চাননি ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। তিনি বলেন, পুলিশ আইনের বাইরে কিছুই করেনি। যা করেছে, আইন অনুসারেই করেছে।
বিএনপি-সমর্থিত মেয়র ও কাউন্সিলর পদপ্রার্থীরা শুরু থেকেই অভিযোগ করে আসছিলেন, পুলিশ তাঁদের কর্মী-সমর্থকদের হয়রানি করছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে গ্রেপ্তারের ভয় দেখাচ্ছে। নির্বাচনের আগের রাতেও পুলিশ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় হানা দিয়ে বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের আটক করে। অনেককে ধরে ভোট কেনাবেচার অভিযোগে মামলাও দিয়েছে।
কাল নির্বাচনের সকালটা শুরু হয় গণমাধ্যমকর্মীদের হয়রানি করার মধ্য দিয়ে। বিভিন্ন কেন্দ্রের ভেতরে ক্যামেরা নিয়ে যেতে বাধা দেয় পুলিশ। এ সময় বেশির ভাগ পুলিশ সদস্যের পোশাকে নাম লেখা কোনো ট্যাগ ছিল না। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে সিদ্ধেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্রের ভেতরে দেখা যায়, কেন্দ্রের নিচতলার একটি কক্ষে কয়েকজন যুবক বসে ব্যালট পেপারে সিল মারছেন। এ সময় একজন সাংবাদিক সেখানে যেতে চাইলে ফটকে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য বলেন, ক্যামেরা নিয়ে ভেতরে যাওয়া যাবে না।
ঢাকা দক্ষিণে নারিন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল, দোতলার একটি ভোটকক্ষ বন্ধ করে দিয়ে সরকার-সমর্থক মেয়র ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকেরা জাল ভোট দিচ্ছেন। কক্ষের বারান্দায় একজন পুলিশ সদস্যকে বসে থাকতে দেখা যায়। ভেতরে যাচ্ছেন না কেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভাই, চাকরি হারাব?’
বিকেল পৌনে চারটায় ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজ কেন্দ্রে এক পুলিশ সদস্যকে ব্যালট পেপারে সিল মারতে দেখা যায়। অন্য পুলিশ সদস্যরা তাঁকে সহযোগিতা করছিলেন।
কামরাঙ্গীরচরে নদিয়া জুনিয়র স্কুল কেন্দ্রে সকাল ১০টা পর্যন্ত কেন্দ্রের মূল ফটক বন্ধ করে রাখেন পুলিশের এসআই মোস্তাফিজুর রহমান। এ সময় আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীর ব্যালট পেপারে সিল মারা চলছিল। বেলা পৌনে একটার দিকে সাংবাদিকরা সেখানে ঢুকতে পারলেও ভিডিও করতে দেওয়া হয়নি।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ইস্পাহানি বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্র দখল করেন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী মোক্তার সরদারের লোকজন। এ সময় দোতলায় বেশ কিছু নারী ভোটার লাঞ্ছিত হন। তাঁরা পুলিশের সহায়তা চাইলে পুলিশ তাঁদের চলে যেতে বলে।
সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান দলবল নিয়ে যান শাঁখারীবাজারের পোগোজ স্কুলে। তখন ওই কেন্দ্রে ভোট বন্ধ ছিল। কিন্তু পুলিশ কমিশনার সাংবাদিকদের বলেন, সব স্থানে সুষ্ঠু ভোট হচ্ছে। এ সময় একজন সাংবাদিক তাঁকে বলেন, এই কেন্দ্রে ভোট বন্ধ আছে।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ওয়ারীর সিলভারডেন প্রিপারেটরি বালিকা বিদ্যালয়ে কিছু যুবক জাল ভোট দিচ্ছিলেন। সাংবাদিকেরা সেখানে যেতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। ওয়ারীর আবদুর রহিম কমিউনিটি সেন্টার কেন্দ্রের দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য সিআইডির এসআই ইফতেখার সাংবাদিকদের বলেন, কেন্দ্রের ভেতরে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো যাবে না। তখন ওই কেন্দ্রে জাল ভোট দেওয়া হচ্ছিল বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
ঢাকা উত্তরের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে শাহ আলী মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ-সমর্থিত টিপু সুলতানের সমর্থকেরা পাঁচটি বুথ দখল করে সিল মারছেন। শাহ আলী থানার উপপরিদর্শক মাঈনউদ্দিন তাঁদের সহায়তা করছেন। তাঁর কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
ঢাকা দক্ষিণের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের মির্জা আব্বাস মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে জাল ভোট প্রদানকারীদের গ্রেপ্তার না করে সহায়তা করেছেন শাহজাহানপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেহেদি হাসান। প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ভোট বন্ধ করে দিলে তিনি চাপ দিয়ে তা আবার শুরু করান। প্রার্থী হামিদুল হকের সমর্থকেরা জাল ভোট দিয়েছেন। অথচ তাঁর হোটেল থেকে পুলিশের জন্য খাবার আনান ওসি।
জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘এখানে কোনো ঘটনা ঘটেনি, কাউকে আমরা দেখিনি। দু-একজন বাইরে এসেছিল, তাদের বের করে দিয়েছি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে জাল ভোট দেওয়ার অভিযোগ শুনে সাংবাদিকেরা সেখানে গেলে কেন্দ্রে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা তাঁদের ফটকে আটকে দেন। দীর্ঘ সময় আটকে রাখার পর তাঁরা সাংবাদিকদের ছেড়ে দেন। ততক্ষণে জাল ভোট দেওয়া শেষ হয়ে যায়। দুপুরের দিকে সিটি কলেজ কেন্দ্র দখল করেন মেয়র প্রার্থী সাঈদ খোকনের কর্মীরা। এ সময় পুলিশ সদস্যরা খোশগল্পে মশগুল ছিলেন।
বেলা দুইটার দিকে পুরান ঢাকার কবি নজরুল কলেজের দোতলায় বসে ১০-১২ জন যুবক প্রকাশ্যে ব্যালটে সিল মারছিলেন। তাঁদের কাজকর্মে কোনো রাখঢাক ছিল না। পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার মোস্তাক আহমেদ বিপুলসংখ্যক পুলিশ নিয়ে সেখানে অবস্থান করছিলেন।
দোতলায় জাল ভোট দেখে এসে আনোয়ার হোসেন নামের এক ভোটার নিচে নেমে চিৎকার করে এর প্রতিবাদ করতে থাকেন। তখন পুলিশ তাঁকে তাড়িয়ে দেয়।