হারের মাঝেও লাভ দেখছে বিএনপি
আজমী আনোয়ার, সিনিয়র রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ ঢাকা ও চট্টগ্রামে তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে হারলেও কিছু লাভ দেখছে বিএনপি। দলের নেতারা বলছেন, এ নির্বাচনের ফলে নিজেদের প্রধান দাবি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি ‘পাকাপোক্ত’ হয়েছে। একই সঙ্গে দলের সাংগঠনিক দুর্বলতাও ফুটে উঠেছে।
ভোটকেন্দ্র দখল, জাল ভোট, বিএনপির ভোট বর্জনের পরও তিন সিটিতেই বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীরা বিপুল ভোট পেয়েছেন। এ নিয়ে দলে দু ধরনের মত পাওয়া গেছে। তবে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের দুজন নেতা বলেছেন, তাঁরা মনে করেন নির্বাচন গ্রহণযোগ্য দেখাতে বিএনপির প্রার্থীদের এত ভোট দেখানো হয়েছে।
জিতলেও লাভ, হারলেও লাভ-এমন একটি সমীকরণ সামনে রেখে ‘আন্দোলনের অংশ হিসেবে’ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গিয়েছিল বিএনপি। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে টানা তিন মাসের আন্দোলনে ছেদ টেনে হঠাৎ সিটি নির্বাচনমুখী হয়েছিল বিএনপি। নির্বাচনের একদিন আগে সংবাদ সম্মেলনে দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন সিটি নির্বাচনকে সরকার, শাসক দল, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে নিয়েছে বিএনপি। স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনেও যদি সন্ত্রাস, ডাকাতি, কারচুপির মাধ্যমে সরকার জনগণের রায় বদলে ফেলে, তাহলে আবারও স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হবে যে এদের অধীনে সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের চিন্তা সম্পূর্ণ অবাস্তব ও অবান্তর।
ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগের মধ্য দিয়ে শেষ হওয়া তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত তিন মেয়র প্রার্থী বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। ভোটের দিনদুপুরেই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয় বিএনপি। দলটির নেতাদের মূল্যায়ন-বিএনপি হারেনি, যা হারার সরকারই হেরেছে। সরকারের ভাবমূর্তি দেশে-বিদেশে আবারও প্রশ্নের মুখে পড়েছে। নির্বাচন কমিশন ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’-প্রমাণিত হয়েছে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমরা জানতাম এমনই হবে। তারপরও কেউ যাতে বলতে না পারে বিএনপি নির্বাচন বিমুখ দল, এ জন্যই আমরা নির্বাচনে গিয়েছি। এখনতো দেশ ও বিশ্ববাসীর কাছে সব পরিষ্কার হয়ে গেল।’
এ নির্বাচনে রাজধানীতে বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থাও খোলাসা হয়েছে। ভোটের একদিন আগে দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ভোটকেন্দ্রে পাহারা বসাতে বলেছিলেন। বলেছিলেন, গণনা শেষে ফলাফল বুঝে নিয়ে কেন্দ্র ত্যাগ করতে।
কিন্তু বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। নির্বাচনের দিন বেশির ভাগ কেন্দ্রে বিএনপি এজেন্ট রাখতে পারেনি। নেতা-কর্মীরা নির্বাচনী মাঠে ছিলেন না। গ্রেপ্তার আতঙ্কে প্রায় সবাই ছিলেন চুপচাপ। সরকারের কৌশল মোকাবিলায় কেউ মাঠে ছিলেন না। মাঠ রাখা ছিল একেবারেই ফাঁকা। ৯০ ভাগ কেন্দ্রে বিএনপির এজেন্ট যাননি। নির্বাচন সমন্বয়ে যুক্ত নেতাদের কেউ কেউ মনে করেন, বিএনপির নেতা-কর্মীরা যদি মাঠে থাকতেন তাহলে পরিস্থিতি অন্য রকম হতো।
নির্বাচন সমন্বয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বিএনপির এমন একজন নেতা তাঁর নিজের মূল্যায়নের কথা বলেন, তাঁর মতে মোটাদাগে তিনটি বিষয় এ নির্বাচনে বিএনপির জন্য উল্লেখযোগ্য। প্রথমত, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি এখন ‘পাকাপোক্ত’ হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এটিও প্রমাণ হয়েছে সাংগঠনিকভাবে বিএনপি এখন খুবই দুর্বল। বিএনপির পক্ষে জনমত থাকলেও আবার সরকার বিরোধী শক্ত আন্দোলন দাঁড় করানোর পরিস্থিতি নেই। তৃতীয়ত, নির্বাচন না করার চেয়ে করাটা ভালো হয়েছে। বিএনপি কিছু হারাইনি, যা হারানোর সরকার হারিয়েছে।
বিএনপির ওই নেতা বলেন তিনি নেতা-কর্মীদের মধ্যে তিনি হতাশা দেখেছেন। তিনি মনে করেন, এই অবস্থায় এখন হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচিতে যাওয়া দলের জন্য ঠিক হবে না। দলকে আবার সংগঠিত করে সভা-সমাবেশের মাধ্যমে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে।
ব্যাপক অনিয়ম, কারচুপি, বিএনপির বর্জন, মাঠে না থাকার পরও দল-সমর্থিত প্রার্থীরা বিপুল ভোট পেয়েছেন। ঢাকা উত্তরে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী আনিসুল হকের চার লাখ ৬০ হাজার ১১৭ ভোটের বিপরীতে বিএনপি-সমর্থিত তাবিথ আউয়াল পেয়েছেন তিন লাখ ২৫ হাজার ৮০ ভোট। ঢাকা দক্ষিণে সাঈদ খোকনের পাঁচ লাখ ৩৫ হাজার ২৯৬ ভোটের বিপরীতে বিএনপি-সমর্থিত মির্জা আব্বাস পেয়েছেন দুই লাখ ৯৪ হাজার ২৯১ ভোট। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে বিএনপি-সমর্থিত মনজুর আলম পেয়েছেন তিন লাখ ৪ হাজার ৮৩৭ ভোট।
বর্জনের পরও বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীদের বিপুল পরিমাণ ভোট পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান বলেন, মিথ্যাকে সত্য বলে প্রচার চালাতে অনেক রং চড়ানো হয়। তবে বিএনপির যে বিপুল জনসমর্থন আছে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তা অবশ্যই প্রমাণিত হতো।
নির্বাচন সমন্বয়ে যুক্ত একজন নেতাও বলেন, তাঁরা মনে করছেন সরকার নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য দেখাতে ‘দয়া করে’ বিএনপির প্রার্থীদের কিছু ভোট দিয়েছে। বিএনপির বেশির ভাগ নেতা-কর্মী ১০টার পর কেন্দ্রেই যাননি। তাই এত ভোট পাওয়ার প্রশ্নই আসে না। তাঁর ভাষায়, আগে একচেটিয়া ভোট দিয়ে বোকামি করা হতো। এখন এভাবে ‘ব্যালান্স’ করা হয়। তবে কেউ কেউ এটাও বলছেন, এতে প্রমাণ হয় নির্বাচন সুষ্ঠু হলে বিএনপি বিপুল ভোটে বিজয়ী হতো।