জিএসপি স্থগিতের সিদ্ধান্ত শ্রমিকদের পক্ষে যাবে না
রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ শ্রম অধিকার বাস্তবায়নে সরকারকে চাপ দিতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যে জিএসপি সুবিধা স্থগিত করলেও তা শ্রমিকদের কাজে আসবে না বলে মনে করেন পোশাক খাতের শ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতারা।
বরং তারা আশঙ্কা করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই ‘কঠোর পদক্ষেপ’ অনুসরণ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নও যদি জিএসপি সুবিধা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে দেশের পোশাক খাত এবং এ খাতে জড়িত ৩৬ লাখ শ্রমিক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ড ও রানা প্লাজা ধসে ১২ শ’র বেশি শ্রমিক নিহত হওয়ার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের পণ্যে অগ্রাধিকারমূলক বাজার-সুবিধা (জিএসপি) স্থগিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
এই সুবিধার আওতায় বাংলাদেশ পাঁচ হাজার ধরনের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধায় রপ্তানি করতে পারত। তবে এর মধ্যে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের পণ্য নেই।
কারখানার কর্ম পরিবেশ ও শ্রমিক অধিকার বাস্তবায়নে সন্তোষজনক অগ্রগতি দেখাতে পারলে বাংলাদেশ আবার এই সুবিধা ফিরে পেতে পারে বলেও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি মাহবুবুর রহমান ইসমাইল এবিসি নিউজ বিডিকে বলেন, “তারা বলছে, এটা তারা শ্রমিকদের স্বার্থে করেছে। কিন্তু এতে করে শ্রমিকদের কোনো উপকার হবে না। তারা বরং কারখানার কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা, শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক মানে মজুরি দেয়া কিংবা ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সরকার ও মালিকপক্ষকে চাপ দিতে পারতো।”
যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধা স্থগিত করার ফলে ইউরোপের বাজারেও এর প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন ইসমাইল।
গার্মেন্ট-শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু জিএসপি স্থগিত করার বিষয়টিকে দেখছেন ‘বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী একটি পদক্ষেপ’ হিসাবে।
এবিসি নিউজ বিডিকে তিনি বলেন, “বিষয়টি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এর কোনো যৌক্তিকতাই থাকতে পারে না।”
যুক্তরাষ্ট্রের এ অবস্থানকে ‘অনৈতিক’ উল্লেখ করে মিশু বলেন, “এখন যদি ইউরোপও এই নীতি অনুসরণ করে আমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে গোটা ইন্ডাস্ট্রি হুমকির মুখে পড়বে। সেক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট এক কোটিরও বেশি মানুষ।”
তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ড এবং সাভারে ভবন ধসে ব্যাপক প্রাণহানির পর কারখানার কর্মপরিবেশের উন্নয়নের এবং শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সেগুলো ইতিবাচক বলেই মনে করেন বাংলাদেশ গার্মেন্ট অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি বাবুল অখতার।
সরকার নেয়া এসব পদক্ষেপ বিবেচনায় না নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রর জিএসপি স্থগিতের সিদ্ধান্ত ‘একেবারেই ঠিক হয়নি’ বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
বাবুল বলেন, এর মধ্যেই ‘বিল্ডিং অব ফায়ার সেফটি’ নামে একটি নিরাপত্তা চুক্তিতে সই করেছে ইউরোপের অধিকাংশ ব্র্যান্ড, যার বাস্তবায়নও শুরু হয়ে গেছে।
“এ অবস্থায় জিএসপি স্থগিত করার কোনো প্রভাব ইউরোপ ইউরোপীয় বাজারে পড়বে বলে মনে হয় না।”
ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের সভাপতি শাহ আতিউল ইসলামও একই মত প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি করে যুক্তরাষ্ট্রে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাবে, ২০১১-১২ অর্থবছরের বাংলাদেশ মোট রপ্তানি করেছে ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের বেশি পণ্য। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে মোট রপ্তানির ২১ শতাংশ যা প্রায় ৫০০ কোটি ডলার।
ওই অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে ৪৯০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানির জন্য বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের শুল্ক বাবদে গুণতে হয় ৭৩ কোটি ডলার।
আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি দামের পোশাক কেনে, যা বাংলাদেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ৬০ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেছে, “দেশের কারখানাগুলোর নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার যেখানে বেশ কিছু উপযুক্ত ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিয়েছে ঠিক সেই সময় বাংলাদেশের কারখানার শ্রমিকদের জন্য জিএসপি বাতিলের মতো সিদ্ধান্তের চেয়ে দুঃথজনক খবর আর হতে পারে না।”
জিএসপি স্থগিতের এই সিদ্ধান্তকে ‘দুঃখজনক’ অভিহিত করে সরকার আশা প্রকাশ করেছে, যুক্তরাষ্ট্র শিগগিরই আবার এই সুবিধা ফিরিয়ে দেবে।
তবে ২০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক খাতের ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ মনে করছেন, ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে’ থেকে সরকারকে চাপে ফেলতেই যুক্তরাষ্ট্র এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আর সরকার সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টিকফা চুক্তির খসড়া অনুমোদন করায় এখনো আলোচনার পথ খোলা রয়েছে বলেও মত দিয়েছেন পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর একজন সাবেক সভাপতি।