নতুন স্নায়ুযুদ্ধ?

 

এবিসিনিউজবিডি ডেস্ক,ঢাকাঃ  ন্যাটো, সৌদি আরব, উপসাগরীয় অঞ্চল এবং আমেরিকা- সবাইকে আকস্মিকভাবে স্তব্ধ করে দিয়ে সিরিয়ায় যুদ্ধে জড়ালো রাশিয়া। কেউ কেউ বলছে বিশ্বে আবার ফিরে এলো সেই স্নায়ুযুদ্ধ যা একসময় ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন আর আমেরিকার মধ্যে। কারণ হিসেবে পশ্চিমারা বলছে, রাশিয়া সিরিয়ায় শুধু আইসিস ঘাটিতেই বোমা ফেলছেনা, বোমা ফেলছে মার্কিন মদদপুষ্ট আসাদ বিরোধী বাহিনীর উপরও। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা স্নায়ুযুদ্ধের ধারণা উড়িয়ে দিয়েছেন। জানিয়ে দিয়েছেন, রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি কোন সংঘাতে যাওয়ার ইচ্ছা তার নেই ।

সিরিয়া সংকটে নিজেকে জড়িয়ে তবে কি ভ্লাদিমির পুতিন এমন বার্তাই বিশ্বকে দিতে চাচ্ছেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই, কিন্তু বিশ্ব রাজনীতিতে রাশিয়া কোনো দেশকে একক আধিপত্য চালিয়ে যেতে দিবে না? সিরিয়ায় সরাসরি এই হস্তক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে রাশিয়ার ৭২ শতাংশ মানুষ। তারা বলছে, ভ্লাদিমির পুতিন ‘গ্রেট লিডার’ যিনি বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিলেন রাশিয়া একটি শক্তিশালী দেশ। প্রশ্ন হলো এই যুদ্ধ স্বল্প স্থায়ী হবে কিনা, নাকি সোভিয়েতের আফগান সংকটের মতো এক দীর্ঘ যুদ্ধে নেমে পড়লো রাশিয়া? রাশিয়ার উপর এই যুদ্ধের অর্থনৈথিক, রাজনৈতিক এবং মানবিক কি প্রভাব ফেলবে তার বিচার বিশ্লেষণও শুরু হয়েছে।

বিশ্ব মোড়লরা এবং মধ্যপ্রাচ্যের সামন্তপ্রভুরা যদি সত্যি সমস্যার সমাধান চান, তাহলে পূর্ব-পশ্চিম বা সিয়া-সুন্নী বিরোধকে দূরে ঠেলে আলোচনায় বসবে আইসিসকে কিভাবে নিশ্চিহ্ন করা যায় সে নিয়ে। এই সংকটের সমাধান পশ্চিমাদের নিজেদের স্বার্থেও প্রয়োজন, কারণ সিরিয়া সংকট যত দীর্ঘায়িত হবে, ইউরোপের শরণার্থী সংকটও ততই জটিল হবে, দীর্ঘায়িত হবে।

পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো বলছে, এই যুদ্ধের সহসা কোন সমাধান চোখে পড়ছে না। জটিলতা বাড়ছে। কারণ রাশিয়ার যুদ্ধ বিমান একাধিকবার তুরষ্কের আকাশ সীমা লংঘন করেছে। আর এর প্রতিবাদ জানিয়েছে তুরষ্ক এবং ন্যাটো। তুরষ্কের প্রেসিডেন্ট এরোদগান সিরিয়ায় আসাদ শাসনের আবসান চান, কিন্তু আইসিস এর বিরুদ্ধে রাশিয়ার আক্রমণও চান। তাই রাশিয়ার যুদ্ধ বিমান তার দেশের আকাশ সীমা লঙ্ঘন করলে তার প্রতিবাদটা তত জোড়ালো হয়না। তুরষ্কের চেয়েও কড়া প্রতিবাদ করে ন্যাটো।

আপাতত এটি পরিষ্কার হয়েছে যে, রাশিয়া আইসিস এবং আল কায়েদা, এই দুই সন্ত্রাসী গোষ্ঠিকে পরাজিত করতেই মাঠে নেমেছে। কিন্তু অন্য বড় কোন উদ্দেশ্য রয়েছে তা এখনো বিশ্বের সামনে খুলে বলেননি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন। বলা হচ্ছে, পুতিন উদ্দেশ্যমূলকভাবেই সংশয় জিইয়ে রেখেছেন।

এদিকে সিরিয়ার সরকার বিরোধী শক্তিকে যেভাবে লালন করেছেন প্রেসিডেন্ট ওবামা ও তার প্রশাসন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সাধারণ মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে। মার্কিন গোয়েন্দা ও সামরিক কর্মকর্তারা স্বীকার করে নিচ্ছেন যেভাবে তারা বাশার বিরোধীদের অস্ত্র, অর্থ আর প্রশিক্ষণ দিয়েছে তা খুব একটা কাজে আসেনি। অনেক মার্কিনীই বলছে, আমেরিকার সরকারের মনে রাখা উচিৎ তাদের কি পরিণতি হয়েছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধে।

তবে সাম্প্রতিককালে রাশিয়ার সাথে কূটনৈতিক খেলায় পশ্চিমারা যে খুব একটা ভাল অবস্থায় নেই সেই আলোচনাও চলছে। ক্রিমিয়া, জর্জিয়া এবং ইউক্রেন, এই তিন খেলায় রাশিয়া তার পেশি শক্তি দেখিয়েছে, এবং পশ্চিমাদের কূটনৈতিক সব প্রচেষ্টা পুতিনের কাছে পরাজিত হয়েছে।

ইউক্রেনের মতো সিরিয়ায়ও পুতিনের কৌশলের কাছে হরেছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। মস্কো আর তেহরান বাশার আল আসাদের সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে যে জোটবদ্ধ হয়েছে, তা পশ্চিমারা টের পেয়েছে অনেক দেরীতে। সিরিয়ায় রাশিয়ার সামরিক সরঞ্জাম যাচ্ছিল বহু সময় ধরে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন যখন বুঝতে পেরেছে রাশিয়া এখানে শক্তিশালি হয়ে উঠছে, তখন কিছু করার আগেই দেখতে পায় পুতিন সিরিয়ায় বোমারু বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে প্রবল অভিযান শুরু করেছেন।

একটি বিষয় সবার কাছে কিছুটা বিস্ময়কর লেগেছে যে, আইসিসের বিরুদ্ধের আমেরিকা আর তার মিত্ররা বছরের পর বছর ধরে লড়েও কিছু করতে পারলো না, সেই দানবীয় আইসিস মাত্র কয়েকদিনের রাশিয়ান আক্রমণে পর্যদুস্ত হলো কি করে? তবে কি ওবামা প্রশাসন আসলে এই সমস্যার আশু সমাধান চাননি? তবে কি শুধু বাসার আল আসাদের বিরোধিতাকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে প্রকারান্তরে মার্কিনীরা আইসিসকে অনেক সময় ও স্থান করে দিয়েছে নিজেদের অবস্থান সংহত করতে?

দীর্ঘ আফগান যুদ্ধ, ইরাক যুদ্ধ, লিবিয়ায় গাদ্দাফিকে অপসারণসহ কোনো মার্কিন উদ্যোগই শান্তি আনতে পারেনি সেসব দেশে। তাই খোদ মার্কিনিরাই এখন বাইরের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমেরিকার এভাবে জড়ানোকে ভালভাবে নিচ্ছেনা।

প্রেসিডেন্ট পুতিন কেবল আইসিস দমনে নেমেছে, এটাও ভাবা যাচ্ছেনা। ইউক্রেন, ক্রিমিয়া এবং জর্জিয়ার মতো সিরিয়াও রাশিয়ার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়া তার নিজস্ব অঞ্চল থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। তাই পশ্চিম এশিয়ায় রাশিয়া তার প্রভাব বাড়াতে চায় সিরিয়াকে দিয়েই। প্রেসিডেন্ট আসাদ ক্ষমতায় টিকে থাকতে নিজের মানুষের উপরই রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আনীত শাস্তি-প্রস্তাবে মস্কো ক্রমাগত ভেটো দিয়ে আসছে। দামাস্কাসে আইসিসের খেলাফত এর পতাকা উড়লে আর সবার মতো রাশিয়াও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেটা হওয়ার আগেই তাই পুতিন যুদ্ধে অবতীর্ণ।

স্নায়ুযুদ্ধের কাল ফেরত এসেছে, এমনটা বলার সময় হযতো এখনই নয়। কিন্তু সিরিয়ায় পরোক্ষভাবে রুশ-মার্কিন সংঘাত শুরু হয়েছে। এমন পরিস্থিতি বিশ্ব বহুদিন দেখেনি। কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাড়ায় তা সময়ই বলে দিবে। তবে একটি কথা বিশ্ববাসি জানলো যে, মার্কিনিদের একক মোড়লপনার দিন ফুরিয়েছে।
লেখক: সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, পরিচালক বার্তা, একাত্তর টেলিভিশন।

 

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ