মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই সাবেক মন্ত্রীর ফাঁসির মঞ্চটিও প্রস্তুত !
বিশেষ প্রতিবেদক, এবিসিনিউজবিডি, ঢাকাঃ যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ আবেদন না করলে বা রাষ্ট্রপতির অনুকম্পা না পেলে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবে কারা কর্তৃপক্ষ।কারা কর্তৃপক্ষ তাদের রায় পড়ে শুনিয়েছে।প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি না ? মৃত্যুদণ্ডপ্রপ্তরা বলছে সিদ্ধান্ত পরে জানাবেন।
এরই মধ্যে এই দুই যুদ্ধাপরাধীর স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ পর্ব সম্পন্ন করা ছাড়াও রিভিউ খারিজের রায় পড়ে শোনানো এবং তাদের ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদনের ইস্যুটি বাকি রেখেই প্রস্তুত করা হয়েছে ফাঁসির মঞ্চটিও। মঞ্চের ওপরে টাঙানো হয়েছে শামিয়ানা। প্রধান জল্লাদকেও প্রস্তুত রাখা হয়েছে। কারা কর্মকর্তাদের দৌড়ঝাঁপ এখন ফাঁসির মঞ্চকে ঘিরেই।
আইনি সব বিষয়ের নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়ায় এখন সাবেক এই দুই মন্ত্রীর সামনে কেবল রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সুযোগই বাকি আছে।
তারা আবেদন না করলে বা রাষ্ট্রপতির অনুকম্পা না পেলে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবে কারা কর্তৃপক্ষ, যার সব প্রস্তুতি ইতোমধ্যে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিআইজি প্রিজন গোলাম হায়দার।
শুক্রবার সকালে আবিসিনিউজবিডি’কে তিনি বলেন, “কাল ট্রাইব্যুনাল থেকে রায়ের অনুলিপি পাওয়ার পর আমরা তাদের পড়ে শুনিয়েছি। ক্ষমা চাইবেন কিনা জানতে চেয়েছি।
“উনারা বলেছেন, সিদ্ধান্ত পরে জানাবেন। উনাদের সিদ্ধান্ত জানার জন্য আজও আমরা তাদের কাছে যাব।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তেজগাঁওয়ে খ্রিস্টান কোঅপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লিমিটেডের এক অনুষ্ঠানের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সাংবাদিকদের বলেন, “সরকার আইনের বাইরে কিছু করবে না। আইনে যেসব পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা আছে, তার সবই করা হবে। ”
পরে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে সাংবাদিকরা মন্ত্রীর কাছে জানতে চান দুই আসামির কেউ প্রাণভিক্ষা চেয়েছেন কি না।
যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ
উত্তরে তিনি বলেন, “আমাদের কাছে এখনও কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি। তারা মার্সি চাইতে পারে। চাইলে আমরা ব্যবস্থা নেব।”
মন্ত্রী বলেন, “দণ্ড কার্যকরের বিষয়টি ঘিরে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে কোনো ধরনের অবনতি ঠেকাতে সরকার প্রস্তুত রয়েছে। দেশের মানুষ রিভিউ খারিজের রায়কে স্বাগত জানিয়েছে।”
বুধবার বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া ওই রায়ে বৃহস্পতিবার বিচারকদের স্বাক্ষরের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হয়ে অনুলিপি পাঠানো হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।
সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির রায়ের কপি নেওয়ার পর আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে রায়ের মূল অংশটি ইংরেজি থেকে বাংলায় তর্জমা করা হয়। রাত সাড়ে ১০টার পর জ্যেষ্ঠ কারা কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে কনডেম সেলে দুই ফাঁসির আসামিকে পড়ে শোনানো হয় ওই রায়।
তখনই জানতে চাওয়া হয়- তারা রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইবেন কি না।
এর আগে যুদ্ধাপরাধী আব্দুল কাদের মোল্লা ও মো. কামারুজ্জামানের রিভিউ আবেদন এক দিনের মধ্যে শুনানি শেষে খারিজ হয়ে গিয়েছিল। তারা রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা চাননি বলে সরকারের পক্ষ থেকে সে সময় জানানো হয়েছিল।
পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের আগে বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে মুজাহিদ ও সাকা চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেন তাদের পরিবারের সদস্যরা।
সাক্ষাৎ শেষে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার পর সাকা চৌধুরীর ভাই জামালউদ্দিন কাদের চৌধুরীর কাছে সাংবাদিকরা প্রাণভিক্ষার আবেদনের বিষয়ে জানতে চান।
জবাবে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তিনি বলেন, “কী, মার্সি পিটিশন?”
একই প্রশ্নে মুজাহিদের ছেলে আলী আহমেদ মাবরুর বলেন, “তিনি (বাবা) বলেছেন, ‘রাষ্ট্রপতি আমাদের রাষ্ট্রের ও জনগণের অভিভাবক। তিনি একজন আইনজীবীও।’ সুতরাং তার কাছে আবেদন করব কি-না আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেব।”
মুজাহিদের আইনজীবী গাজী এইচ এম তামিম শুক্রবার সকালে এবিসিনিউজবিডি’কে বলেন, “আমরা পাঁচ জন আজ সাড়ে ১০টায় কারাগারে গিয়ে উনার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চেয়েছিলাম। কারা কর্তৃপক্ষ আমাদের অনুমতি দেয়নি।”
আর সাকা চৌধুরীর আইনজীবী হুজ্জাতুল ইসলাম খান আলফেসানী বলেন “পরিবারের সদস্যরা আমাদের বলেছেন, প্রাণভিক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন। আমরা আজ কারাগারে গিয়ে দেখা করার অনুমতি চাইব।”
এদিকে রিভিউয়ের রায় হওয়ার পর বুধবার থেকেই কারাফটকে জোরদার নিরাপত্তা রয়েছে। সাঁজোয়া যান নিয়ে পুলিশের অবস্থানের পাশাপাশি রয়েছে র্যাবের টহলও।
চকবাজার থানার ওসি শামীমুর রশীদ ও র্যাব-১০ এর অধিনায়ক জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর দুজনেই বলেন, ফাঁসির দুই আসামি থাকায় তারা নিরাপত্তা জোরদার করেছেন।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাংবাদিক, শিক্ষকসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং সাম্প্রদায়িক হত্যা-নির্যাতনের দায়ে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তিনি আপিল করলে চলতি বছরের ১৬ জুন চূড়ান্ত রায়েও ওই সাজা বহাল থাকে।
একাত্তরে চট্টগ্রামের ত্রাস সালাউদ্দিন কাদেরের রায় এসেছিল ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর। ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির রায় এ বছর ২৯ জুলাই আপিলের রায়েও বহাল থাকে।
তাদের আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় একই দিনে, ৩০ সেপ্টেম্বর। এরপর নিয়ম অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল দুজনের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে এবং কারা কর্তৃপক্ষ ১ অক্টোবর তা দুই ফাঁসির আসামিকে পড়ে শোনায়।
এরপর দুই যুদ্ধাপরাধী ওই রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আপিল বিভাগে আবেদন করেন। শুনানি শেষে বুধবার আদালত তা খারিজ করে দেয়।
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ও আপিল বেঞ্চের অন্য তিন বিচারকের দেওয়া দুই রায়েই বলা হয়, আপিল শুনানির পর দেওয়া রায়ে কোনো ত্রুটি বিচারকদের নজরে আসেনি। সুতরাং দণ্ড পুনর্বিবেচনার কোনো কারণও তারা খুঁজে পাননি।
দণ্ড কার্যকরের আগে দুই যুদ্ধাপরাধীর শেষ আইনি সুযোগ ছিল রিভিউ আবেদন। তা খারিজের মধ্য দিয়ে আইনি লড়াইয়ের পরিসমাপ্তি হয়।
বুধবার রিভিউ খারিজের রায় হওয়া পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি নিষ্পত্তি হলেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দিনক্ষণ ঠিক করা হবে।
কারাবিধিতে ক্ষমা চাওয়ার জন্য সাত দিন সময়ের উল্লেখ থাকলেও আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে তার কোনো সুর্নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া নেই। তবে এই আইনে কারাবিধি প্রযোজ্য হয় না।
কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরের আগে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছিলেন, প্রাণভিক্ষা চাওয়ার জন্য আসামি ‘যৌক্তিক সময়’ পাবেন। এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেছিলেন, একটি দরখাস্ত লিখতে যে সময় লাগে- ‘যৌক্তিক সময়’ তার চেয়ে বেশি হওয়া উচিৎ নয়।