মোবাইলফোনের ব্যাটারি নিয়ে যত সমস্যা

লাইফস্টাইল ডেস্ক, এবিসিনিউজবিডি, ঢাকা: মোবাইলফোনের ব্যাটারি ফুল চার্জ দেখাচ্ছে কিন্তু মোবাইল চালু হচ্ছে না, অথবা কেনার সময় আপনাকে জানানো হয়েছে ৬ ঘণ্টা একটানা ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু দেখা গেল ২ ঘণ্টা না যেতেই চার্জিং সাইন লাল দেখাচ্ছে। মানে চার্জ শেষ, নতুন করে চার্জ দিতে হবে।

আজকাল এমন সমস্যা মোবাইলফোনের ক্ষেত্রে আকছার দেখা যাচ্ছে। ব্যাটারি ফুলে যাওয়া, পানি ছেড়ে দেওয়া, চার্জ না নেওয়া, এমন সব সমস্যা আজকাল হর-হামেশাই ঘটছে, বিশেষ করে অপরিচিত বা কম পরিচিত ব্র্যান্ডের মোবাইলে ফোনসেটের বেলায়। এসব দেখার কোনও নিয়ন্ত্রক সংস্থা না থাকায় এক শ্রেণির মোবাইলফোন ব্যবসায়ী এই সুযোগ নিচ্ছে। ফলে ক্রেতারা মোবাইলফোন কিনে ঠকছেন। ব্যাটারির সমস্যার কারণে নষ্ট হচ্ছে সাধের মোবাইলফোনটিও। সঠিক কোনও পরিসংখ্যাণ না থাকলেও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে বিক্রি হওয়া মোবাইলফোন সেটের মধ্যে ৪০-৫০ শতাংশ ব্যাটারি সংক্রান্ত সমস্যায় আক্রান্ত। এরমধ্যে বার বা ফিচারফোনের সংখ্যা বেশি। অন্যদিকে স্মার্টফোনে বিভিন্ন অ্যাপস থাকার ফলে এমনিতেই বেশি চার্জ ব্যবহার হয়।

জানা গেছে, মোবাইলফোনের ব্যাটারির মান পরীক্ষার জন্য রয়েছে টেস্টিং মেশিন অ্যানালাইজার। এই মেশিন রয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিতে। মোবাইলফোন আমদানিকারকরা পরীক্ষার জন্য স্যাম্পল হিসেবে মোবাইলফোন সেট বিটিআরসিতে পাঠিয়ে থাকেন। সেই মোবাইল সেট পরীক্ষা করে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি ‘মোবাইল সেটটি মানসম্মত’ বলে সনদ দিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে বিটিআরসি তাদের মতো করে সেট পরীক্ষা করে না। আমদানিকারকরা আমদানি করা মোবাইলফোনের মধ্য থেকে তাদের পছন্দ মতো সেট পরীক্ষা করতে বিটিআরসিতে পাঠান। অনেক সময় বিটিআরসিও বাজার থেকে সেট সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে থাকে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুভঙ্করের ফাঁকি এখানেই। নামকরা ব্র্যান্ড ছাড়া কম দামের মোবাইলফোন এবং অনামি মোবাইলফোন (নন ব্র্যান্ডেড)এর আমদানিকারকরা এই সুযোগ নিয়ে অনিষ্ট সাধন করছেন।

বাংলাদেশ মোবাইলফোন ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমপিআইএ) সহ-সভাপতি রেজওয়ানুল হক সাংাদিকদের বলেন, যত সমস্যা আসলে ব্যাটারিতেই। এই সমস্যা আসলে আমাদের অনেক ভোগাবে। হাতেগোনা কয়েকজন মান নিয়ন্ত্রণ করছে। অন্যদের দেখার কেউ নেই। বাজারভিত্তিক কোনও নিয়ন্ত্রক সংস্থা নেই। ফলে আমার মনে হচ্ছে, বিশাল বড় একটা ঝামেলা সামনে আসছে।

স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের আরও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সামনের দিনগুলোতে ব্যাটারি সমস্যা প্রকট হয়ে উঠবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে এ ব্যাপারে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
তিনি বলেন, মোবাইলের প্রবৃদ্ধিতে ব্যাটারি একটি বড় ভূমিকা পালন করবে। ব্যাটারি ভালো না হলে প্রবৃদ্ধির হার হবে নিম্নগামী।

তিনি বলেন, সিম্ফনি এ ব্যাপারে কঠোরভাবে মান নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আমাদের দেশে এবং চীনে রয়েছে নিজস্ব ল্যাব। ব্যাটারির মান নিয়ে কোনও আপস নয় বলে তিনি জানান।

রেজওয়ানুল হক বলেন, ২০১৫ সালে দেশে মোট ২ কোটি ৬০ লাখ মোবাইলফোন সেট আমদানি হয়েছে। এর ২৩ ভাগ (৬০ লাখ) ছিল স্মার্টফোন। আমাদের ধারণা ২০১৬ সালে মোবাইল ফোন আমদানির সংখ্যা হবে ৩ কোটি।

তিনি জানান, ২০১৩ সালে ২৫ লাখ, ২০১৪ সালে ৪০ লাখ, ২০১৫ সালে ৬০ লাখ স্মার্টফোন দেশে আমদানি হয়েছে। ২০১৬ সালে তা হতে পারে ৯০ লাখ অর্থাৎ মোট ফোনের ৩০ শতাংশ। তিনি উল্লেখ করেন, প্রতি বছর স্মার্টফোনের ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হার ৫০ শতাংশ। আমাদের ধারণা, দেশে বর্তমানে সক্রিয় মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৮ কোটি (অনেকের একাধিক সিম থাকায় ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৩ কোটির বেশি)। এর মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ (দেড় কোটির কিছু বেশি) স্মার্টফোন ব্যবহার করে। তার মতে, সঠিকভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষার অভাবে এসব স্মার্টফোনের মধ্যে আসতে পারে নিম্নমানের ব্যাটারি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিকে একটি অ্যানালাইজার মেশিন উপহার দিয়েছে বিআইএমপিএ। এ ছাড়াও নিয়ন্ত্রক সংস্থার রয়েছে একাধিক অ্যানালাইজার মেশিন। ওইসব মেশিনেই মোবাইলফোনের ব্যাটারি পরীক্ষা করা হয়। জানতে চাইলে বিটিআরসির কমিশনার (স্পেক্ট্রাম ম্যানেজমেন্ট) এটিএম মনিরুল আলম বলেন, আমাদের কাছে যেসব অ্যানালাইজার আছে, সেগুলোতে মোবাইলের ব্যাটারি পরীক্ষা করে প্রতিবেদন (সনদ দেওয়া হয়)। মান ঠিক না থাকলে সেগুলো আমরা ধরে ফেলি। ছাড়পত্র দিই না।

দেশীয় মোবাইলফোন ওয়ালটনের অপারেটিভ ডিরেক্টর উদয় হাকিম প্রতিবেদকে বলেন, ওয়ালটন কর্তৃপক্ষ মোবাইলের ব্যাটারির মান নিয়ন্ত্রণ করে কঠোরভাবে। সঠিক মিলি অ্যাম্পিয়ার যাচাইয়ের জন্য নিজস্ব ল্যাবরেটরিতে স্বয়ংক্রিয় ব্যাটারি অ্যানালাইজারের মাধ্যমে মান নিশ্চিত করেই বাজারে মোবাইল ছাড়ছে ওয়ালটন। বিটিআরসির নির্দেশিত মানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই ব্যাটারির মান নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, এরপরও গ্রাহক সন্তুষ্টির কথা বিবেচনা করে ব্যাটারির ক্ষেত্রে ৬ মাসের রিপ্লেসমেন্ট ওয়ারেন্টিও দিচ্ছে ওয়ালটন। এছাড়াও সারাদেশের সার্ভিস পয়েন্টগুলো থেকেও বিক্রয়োত্তর সেবা দিয়ে থাকে ওয়ালটন।

দেশীয় ব্র্যান্ড সিম্ফনির হেড অব কোয়ালিটি কন্ট্রোল (বাংলাদেশ) মাজহারুল ইসলাম বলেন, ব্যাটারি খারাপ হলে অনেক সময় মোবাইল সেট চালু হবে না, পারফরমেন্স হ্যাম্পার করবে। আইডি-ও (ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইন) পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে (ব্যাটারি ফুলে যাওয়া)। ফলে দেখা যায়, সেটের ব্যাক-কভার ঠিক মতো লাগছে না। ব্যাটারি অনেক সময় গলে যেতে পারে এবং সেই অবস্থায় মোবাইল চার্জ দিলে তাতে বিস্ফোরণ হতে পারে। এতে করে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা থেকে যায়।

তিনি বলেন, অনেক সময় দেখা যায় মোবাইলে হয়তো লেখা আছে ব্যাটারির সক্ষমতা ২ হাজার ৫০০ মিলি অ্যাম্পিয়ার আওয়ার (sAh)। কিন্তু ব্যবহারের সময় দেখা গেল তাতে রয়েছে ২ হাজার মিলি অ্যাম্পিয়ার আওয়ার। অনেক মোবাইল আমদানিকারক উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন ব্যাটারির আকর্ষণ দেখিয়ে মোবাইলসেট বিক্রি করে।

তিনি উল্লেখ করেন, দেখা গেলো, অনেক মোবাইলে লেখা থাকে ব্যাটারি ৪ হাজার মিলি অ্যাম্পিয়ার আওয়ার। অ্যানালাইজার দিয়ে পরীক্ষা করালে দেখা যাবে তা ৩ হাজার বা ৩ হাজার ৫০০-এর বেশি নয়। সঠিকভাবে বাজার পরীক্ষা না করার ফলে গ্রাহক প্রতিনিয়ত ঠকছে বলে তিনি মনে করেন।

মাজহারুল ইসলাম আরও বলেন, একজন গ্রাহকের পক্ষে মোবাইল কেনার সময় কোনওভাবেই বোঝা সম্ভব নয় ব্যাটারিটি ভালো না খারাপ। মোবাইলফোন সেট ক্রেতা কোনওভাবেই বুঝতে পারবে না কীভাবে চেক করতে হয়। তবে সেটটি ৮ বা ৪ ঘণ্টার ল্যাব টেস্টের মাধ্যমে বলা সম্ভব।

ব্যাটারি খারাপ দেওয়ার আরও একটি কারণ জানালেন তিনি। গ্রাহকের হাতে কম দামে মোবাইল দিতে হলে অবশ্যই কম দামের ব্যাটারি দিতে হবে। কম দামের ব্যাটারি দিলে কস্টকাটিংয়ে সুবিধা হয় মোবাইলফোন নির্মাতা ও আমদানিকারকদের।

 

 

 

 

সুত্রঃ বাংলা ট্রিবিউন

 

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ