বঙ্গোপসাগর, ভারত মহাসাগর ও চীন সাগরে রণসজ্জা
নিউজ ডেস্ক, এবিসিনিউজবিডি, ঢাকা: বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী আন্ডার-সি মিসাইলের চূড়ান্ত পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপন করতে যাচ্ছে ভারত। কে-৪ নামের ওই ক্ষেপণাস্ত্র ৭ বা ৮ মার্চ ছোড়া হবে বঙ্গোপসাগরের গভীর থেকে।
নির্মাতা সংস্থা ডিফেন্স রিচার্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (ডিআরডিও) পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তাদের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন।
সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপযোগ্য ওই মিসাইল ২০০০ কিলোগ্রাম ওজনের পরমাণু অস্ত্র বহন করে ৩৫০০ কিলোমিটার দূরে আঘাত হানতে পারবে। বঙ্গোপসাগের এধরনের ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার ঘোষণা এমন এক সময় দিল ভারত যার দিন কয়েক আগে দেশটির সঙ্গে যৌথ নৌমহড়া করার ঘোষণা দেয় ইরান। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ইরানের নৌবাহিনীর প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল হাবিবুল্লাহ সাইয়্যেরি জানান, ভারতের সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়া চালাবে ভারত।
সাইয়্যেরি বলেন, ভারতের সেনাবাহিনীর সঙ্গে স্বল্প দিনের মহড়া চালাবে ইরান। এছাড়া, ভারতের সঙ্গে বড় আকারের কৌশলগত মহড়ার পাশাপাশি উদ্ধার এবং ত্রাণ মহড়াও চালানো হবে। ভারতের নেভাল অপারেশন সংক্রান্ত উপ প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাতের পর এ কথা জানান সাইয়্যেরি। ভারত মহাসাগরের উত্তরে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সহায়তা নিয়ে আলাপ করেন তিনি।
অ্যাডমিরাল সাইয়্যেরি বলেন, বিশ্ব এবং ইরানের নিরাপত্তার জন্য ভারত মহাসাগরের অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে। কাজেই ইরান উত্তর ভারত মহাসাগরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে।
এদিকে ইরানের বন্দর আব্বাসে এপ্রিল কিংবা মে মাসে ভারতীয় নৌবাহিনী নোঙ্গর করবে। গত বছরের আগস্টে ইরানি নৌবহর চারদিনের জন্য ভারত সফরে যায়। এছাড়া, গত জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে ইরানের ডেস্ট্রয়ার আলিভান্দ নৌমহড়ায় যোগ দেয়ার জন্য ভারত গিয়েছিল।
এর আগে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ইরানের নৌবাহিনী প্রধান বাংলাদেশ সফর করেন।
এদিকে ভারতে কে-৪ ক্ষেপণাস্ত্র খুব গোপনে তৈরি করেছে ডিআরডিও। এ ক্ষেপণাস্ত্রের একটি সফল পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপন ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে।
তবে সে বার ৩০০০ কিলোমিটার দূরে ছোড়া হয়েছিল ক্ষেপণাস্ত্রটি। আর দিনকয়েকের মধ্যে যে উৎক্ষেপন হতে চলেছে, সেই উৎক্ষেপনে কে-৪ ক্ষেপণাস্ত্র তার পাল্লার সম্পূর্ণ দূরত্ব অতিক্রম করেই আঘাত হানবে।
সমুদ্রগর্ভ থেকে নিক্ষেপযোগ্য যে সব মিসাইল ভারতের হাতে রয়েছে, তার মধ্যে কে-৪ সবচেয়ে দীর্ঘ পাল্লার। উৎক্ষেপন স্থল থেকে ৩৫০০ কিলোমিটার দূরে আঘাত হানার ক্ষমতা থাকায় এটি ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জ ব্যালিস্টিক মিসাইল বা আইআরবিএম গোত্রে পড়ছে।
সমুদ্রগর্ভ থেকে নিক্ষেপযোগ্য যত রকমের আইআরবিএম এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে তৈরি হয়েছে, ভারতের তৈরি কে-৪ সেগুলির মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সবচেয়ে বিধ্বংসী বলে দাবি ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের।
এদিকে চীনের সঙ্গে মারাত্মক টানাপড়েনের মধ্যেই দক্ষিণ চীন সাগরের কাছে সামরিক মহড়া চালানোর সব আয়োজন শেষ করেছে আমেরিকা। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে ভারত ও জাপানকে নিয়ে এ মহড়া শুরু করবে মার্কিন বাহিনী।
ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে গত সপ্তাহে এক সংবাদ সম্মেলনে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মার্কিন কমান্ডার অ্যাডমিরাল হ্যারি হ্যারিস জানিয়েছেন, এবারের মহড়ার নাম দেয়া হয়েছে ‘মালাবার’ এবং এ মহড়া ফিলিপাইন সাগরের উত্তরাংশে অনুষ্ঠিত হবে।
এ সম্পর্কে মার্কিন ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলেছে, ২০১৪ সাল থেকে ভারত ও আমেরিকার নৌবাহিনীর মধ্যে বার্ষিক যে মহড়া অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে তারই অংশ হিসেবে এবারের মহড়া হতে যাচ্ছে। তবে এবারের মহড়ায় জাপান অংশ নেবে।
দিল্লিতে সংবাদ সম্মেলনে অ্যাডমিরাল হ্যারিস জাপানের অংশগ্রহণকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, টোকিওর মতো সামরিক শক্তির অংশগ্রহণের কারণে এবারের মহড়ার জটিলতা বেড়েছে এবং আমেরিকা ও ভারতের জন্য জাপানের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ আসছে। অ্যাডমিরাল হ্যারিস বলেন, প্রতি বছর ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ চীন সাগর দিয়ে ৫.৩ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থের বাণিজ্যিক পণ্য আসা-যাওয়া করে। আসন্ন মহড়ার মাধ্যমে এ অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে।
এর মানে দক্ষিণ চীন সাগরের কাছে আমেরিকা, জাপান এবং ভারত যৌথ নৌমহড়ার পরিকল্পনা করেছে। চলতি বছর ফিলিপাইনের উপকূলে এ মহড়া অনুষ্ঠিত হবে বলে জানানো হয়েছে। এ মহড়ার মাধ্যমে চীনের সঙ্গে আমেরিকাসহ মিত্রদেশগুলোর উত্তেজনা আরো উত্তেজনাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে কি না সে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
লক্ষ্য করার মত বিষয় হচ্ছে দক্ষিণ চীন সাগরকে সামরিকীকরণের বিষয়ে বেইজিং’র বিরুদ্ধে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মার্কিন কমান্ডের প্রধান অ্যাডমিরাল হ্যারি বি. হ্যারিসের হুঁশিয়ারির একদিন পরই মহড়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
গত বছর জাপানকে অন্তর্ভুক্ত করতে বার্ষিক নৌমহড়াকে বঙ্গোপসাগরে পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। ওই অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবই ছিল ওই মহড়ার উদ্দেশ্য।
লক্ষ্য করলে দেখা যায় উত্তর কোরিয়া পূর্ব সাগর বা জাপান সাগরে বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্রপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছে। দেশটির বিরুদ্ধে জাতিসংঘ নতুন করে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পরই এ সব ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা শুরু করেছে পিয়ংইয়ং।
কোরিয় উপদ্বীপের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত উত্তর কোরিয়ার ওনস্যান নৌঘাঁটি থেকে এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হচ্ছে। এ বিষয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী মুন স্যাং-গাইন বলেছেন, ক্ষেপণাস্ত্রের সঠিক সংখ্যা এবং প্রকৃতি সম্পর্কে সঠিক তথ্য এখনো পাওয়া যায় নি তবে সবগুলোই সাগরে পড়েছে।
উত্তর কোরিয়ার পক্ষ থেকে জানুয়ারি মাসে পরমাণু বোমার পরীক্ষা চালানো এবং গত মাসে উপগ্রহ নিক্ষেপের দায়ে বুধবার দেশটির বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। গত ২০ বছরে দেশটির বিরুদ্ধে যে সব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে তার মধ্যে এটিই সবচেয়ে কঠোর। এ ছাড়া, উত্তর কোরিয়ার পরমাণু পরীক্ষার জের ধরে দেশটির ১২ ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বসে আছে আমেরিকা।
নতুন নিষেধাজ্ঞা অনুযায়ী, উত্তর কোরিয়া বছরে ১০০ কোটি ডলারের বেশি মূল্যের কয়লা ও খনিজ পদার্থ রফতানি করতে পারবে না। এ নিষেধাজ্ঞার বাস্তবায়ন যাচাই করার লক্ষ্যে উত্তর কোরিয়া থেকে যাতায়াতকারী সব কার্গো পরীক্ষা করা হবে।
এদিকে দক্ষিণ চীন সাগরের ফিলিপাইন উপকূলের একটি বিতর্কিত ক্ষুদ্র দ্বীপ বেইজিং দখল করে নেয়ার পর ওই এলাকায় অন্তত পাঁচটি চীনা জাহাজ মোতায়েন করার পর জাহাজগুলোর নাবিকরা ফিলিপাইনের জেলেদেরকে দ্বীপটিতে ঢুকতে দেয় নি। একই সাথে চীনা জাহাজগুলো তাদেরকে ওখান থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে।
এ সব জাহাজ কুইরিনো অ্যাটল নামে পরিচিত দ্বীপটি কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। এ দ্বীপটি জ্যাকসন অ্যাটল নামেও পরিচিত। এ দ্বীপে ফিলিপাইনের জেলেরা পালাওয়ান প্রদেশসহ অন্যান্য এলাকা থেকে মাছ ধরতে যেত।
এদিকে ফিলিপাইনের একজন সেনা মুখপাত্র বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, চীনা উপস্থিতির বিষয়টি তারা খতিয়ে দেখছেন।
একই সঙ্গে ভারতের আন্দামান এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কাছাকাছি জলসীমায় চীনের গণমুক্তি নৌবাহিনীর সাবমেরিনের টহল দেয়ার ঘটনা বাড়ছে। এমন এক প্রেক্ষাপটে আন্দামান এবং নিকোবরে নিরাপত্তা জোরদার করছে ভারত। পাশাপাশি এ দুই এলাকায় ভারত দ্রুত গতিতে বাড়িয়ে চলেছে সামরিক অবকাঠামো।
আন্দামান এবং নিকোবরের কাছাকাছি পানিসীমায় চীনা সাবমেরিনকে সহায়তাকারী জাহাজের উপস্থিতি ভারতের রাডারে ধরা পড়ে। তাতে ধারণা করা হচ্ছে, ওই এলাকার আশেপাশে এক বা একাধিক চীনা সাবমেরিন ঘোরাঘুরি করছে।
ভারতের মূল ভূখ- থেকে প্রায় ১,২০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এ দ্বীপপুঞ্জ। এর ৫০০ কিলোমিটারের মধ্যেই যেকোনো সময়ে চীনা নৌবাহিনীর জাহাজের উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়। এ দুই এলাকায় ভারতের প্রচুর সামরিক সম্পদ রয়েছে। সে কারণে এ এলাকায় চীনা নৌবহরের উপস্থিতিকে গুরুত্বের সঙ্গেই নিয়েছে ভারত।
গত কয়েক বছর ধরে বিশেষ করে গত এক বছরে আন্দামান ও নিকোবরে সামরিক অবকাঠামো জোরদার করার জন্য ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছে ভারত। এর অংশ হিসেবে এ এলাকায় ক্ষেপণাস্ত্রবাহী যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে দেশটি। এছাড়া, আরো রাডার বসানোর পদক্ষেপ নিয়েছে নয়াদিল্লি।
এর পাশাপাশি চীনা জাহাজের গতিবিধির ওপর নজর রাখছে ভারত। এ তথ্য দিয়েছেন আন্দামান এবং নিকোবর কমান্ড বা এএনসির প্রধান ভাইস অ্যাডমিরাল পি কে চ্যার্টাজি। তিনি বলেন, আগামী পাঁচ বছরে পুরো কাহিনীই পাল্টে যাবে। তিনি আরো জানান, আন্দামান এবং নিকোবরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর নির্মাণ তৎপরতা এতই ব্যাপক যে, গত বছরে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সেরা ট্রফি পেয়েছে সেখানকার ভারতীয় সেনা প্রকৌশলী দল। ভারতের ৩৩টি এলাকাকে পরাজিত করে এ ট্রফি অর্জন করেছে তারা।
সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা