তনু হত্যার বিচারের পথ খুলে দিন
নিউজ ডেস্ক, এবিসিনিউজবিডি,
ঢাকাঃ কুমিল্লার কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনু হত্যার বিচারে যে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে, তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চাইলে শুধু দূর করতেই পারে না, তনুর হতভাগ্য মা-বাবাসহ ন্যায়বিচার প্রত্যাশী কোটি মানুষকে নতুন করে আশাবাদী করে তুলতে পারে।
বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা প্রথম প্রকাশ্যে তনু হত্যার বিচারের ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। আর এখন বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানও তনু হত্যার বিচারের ব্যাপারে হতাশা ব্যক্ত করলেন। তবে ‘চিকিৎসকদের’ কারণে বিচারের পথ বন্ধ হয়ে পড়েছে মর্মে কমিশন চেয়ারম্যান যে মন্তব্য করেছেন, তা খতিয়ে দেখার দাবি রাখে।
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরিতে দুবারই কমবেশি অযত্ন ও অদক্ষতার ছাপ উল্লেখযোগ্য বলেই প্রতীয়মান হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তনু হত্যার ন্যায়বিচার লাভের সব পথ রুদ্ধ হয়ে পড়েছে কি না? এর উত্তর হলো না। একদম না।
চিকিৎসকেরা তাঁদের কোনো রিপোর্টেই তনুর মৃত্যুকে আত্মহত্যা বা স্বাভাবিক বলেননি, যদিও তাঁরা মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটন করতে পারেননি। বিদেশে এমন ঘটনা বিরল কিন্তু যখন এমন পরিস্থিতি আসে তখন তাঁরা কী করেন, সে বিষয়টি এখন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বিবেচনায় নিতে হবে।
বাংলাদেশের প্রথম ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ মোজাহেরুল হক প্রথম আলোকে বলেছেন, বিদেশে এসব ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে একটি বিশেষ ধরনের তদন্ত কমিটি করা হয়। মোজাহেরুল, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে যাঁর তিন বোন নিহত হয়েছেন, তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোতে তনু হত্যার বিচার বন্ধ হওয়া বিষয়ে ড. মিজানের যে বক্তব্য ছাপা হয়েছে, তার সঙ্গে তিনি একমত নন। কারণ, তাঁর কথা আবেগপ্রসূত যুক্তিনির্ভর নয়।
আমি মোজাহেরুল হককে সমর্থন করে বলব তনুহত্যা তদন্তে প্রথাগত নয়, একটি বিশেষ কমিটি হোক। ওই কমিটি তনুর মরদেহের সুরতহাল, ময়নাতদন্ত, ডিএনএসহ সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়ায় যাঁরাই যেখানে যতটুকু জড়িত ছিলেন, তাঁদের প্রত্যেকের পৃথক সাক্ষাৎকার নেবেন এবং তা রেকর্ড করবেন। ধরে নেব, সেসব গ্রন্থনা করলে অনেক দরকারি প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। মিসিং লিংক জোড়া লাগবে। সাক্ষ্যপ্রমাণ, তথ্য-উপাত্ত ও ঘটনার পরম্পরা পর্যালোচনা করে তদন্তপ্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়ার কথাই ভাবতে হবে। বাস্তবে তেমন কিছু পাওয়া যাবে না, সেটা অনুমান করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষে যা করা সম্ভব তা-ও না করা হবে দুর্ভাগ্যজনক।
তনুর নিহত হওয়ার স্থান এখনো অজানা থাকলে সেটা শনাক্ত করা দরকার। মেডিকেল নেগলিজেন্স ও মেডিকেল এরর—সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। তনুর দুবারের ময়নাতদন্তের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে একটি বিষয় পরিষ্কার হতে পারে যে তাঁরা কেন ব্যর্থ হয়েছিলেন। সেটা মেডিকেল জুরিসপ্রডেন্সকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার খাতিরেও জানাবোঝার গুরুত্ব অপরিসীম।
এখন কথা হলো, এ ধরনের তদন্ত সরকারি হাসপাতালের প্রথাগত নামজাদা অধ্যাপক বা কোনো পরিচালক বা ডিআইজি কী সচিব ধরনের কোনো কর্মকর্তা দিয়ে করালে হবে না। মনে রাখতে হবে, ফরেনসিক সায়েন্স ও মেডিকেল জুরিসপ্রডেন্স দুটোরই বড় দৈন্য চলছে দেশে। রাজনৈতিকভাবে ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয় বলে অনেকে হয়তো এফবিআই ধরনের বিদেশি সংস্থাকে কুমিল্লায় ডাকার মতো চিন্তা মাথায় আনেননি।
আমরা মনে করি, একটি বিচারবিভাগীয় তদন্ত হোক, একজন কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত বিচারককে প্রধান করে তাঁর নেতৃত্বাধীন কমিটিতে একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ও অন্যান্য দিকসংশ্লিষ্ট টেকনিক্যাল লোকদের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
চিকিৎসকেরা ব্যর্থ হয়েছেন এর মধ্য দিয়েই উপসংহার টানা উচিত হবে না। এটাকে দেখতে হবে শুরু হিসেবে। চিকিৎসকেরা রিপোর্ট দিয়েছেন এবার তাঁরা সাক্ষাৎকার দেবেন। তাঁরা কোনটি করেছেন আর কোনটি কেন করেননি, তার সদুত্তর দেবেন। অথচ এমন একটা ধারণা দেওয়া হচ্ছে যে আমাদের আর তেমন কিছুই করার নেই। কাউকেই দোষারোপ করে থামলে চলবে না। যেখানে যা ভাঙাচোরা যা আছে তা জোড়াতালি দিয়ে হলেও কাজ এগিয়ে নিতে হবে। তনু হত্যাকাণ্ড দেশের সর্বস্তরের মানুষের আবেগকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছে। তাই তাদের অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে সরকারের দায় আছে। কিছু না পাওয়া গেলেও সরকারকে এটা করতে হবে। কারণ, তনুই শেষ উদাহরণ নয়। কিছু কেন পাওয়া গেল না, সেটা চিহ্নিত করা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ভবিষ্যতে এমন পুনরাবৃত্তি যেন আমরা রোধ করতে পারি। সুতরাং তদন্ত টিম করে হবেটা কী, সেটা হলো সব থেকে ভয়ংকর কুযুক্তি।
মোজাহেরুল হক মনে করেন, সব আলামত নিশ্চিহ্ন করার একটা কথিত প্রয়াসের খবর পত্রিকান্তরে ছাপা হলেও ডিএনএ টেস্টের উপাদান ঘটনাস্থল থেকে এখনো সংগ্রহ করা সম্ভব, যা মামলার মোড় পাল্টে দিতে পারে। ঘটনাস্থলে যদি হত্যাকারী এসে থাকে, তাহলে তারই অজান্তে রেখে যাওয়া কোনো আলামতও ডিএনএর জন্য যথেষ্ট হতে পারে। তনুর মতো পরিস্থিতিতে মেয়েরা বাঁচার জন্য খামচাখামচি করে, তখন তাঁর নখের আঁচড়ে (নেল স্ক্রাপিং) আততায়ীর শরীরের চামড়ার কোনো অংশ এসে যায়। এমনকি ঘটনাস্থলে ঘাতক যদি হাঁচি, কাশি দেয়, থুতু ফেলে তাহলে তা থেকেও ডিএনএ টেস্ট করা সম্ভব। তনুর চুল কাটা ছিল। ধস্তাধস্তির সময় ঘাতকের চুলও পড়ে যেতে পারে, তা থেকেও তার পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব। আবার ‘ঘটনাস্থলে’ তনুর যেমন তেমনি এক বা একাধিক ঘাতকের ফিঙ্গার প্রিন্ট মিলবে। তাই যাদেরই আঙুলের ছাপ মিলবে, তাদের আমরা সন্দেহভাজন হিসেবে আনতে পারি। এসব কারণে ‘ঘটনাস্থল’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মিজানুর রহমান যিনি ‘উচ্চপর্যায়ের’ মৌখিক অনুমতি নিয়ে সেনানিবাস এলাকায় ‘ঘটনাস্থল’ পরিদর্শন করেছিলেন, তিনি বৃহস্পতিবার তাঁর দপ্তরে আমাকে বলেন যে তাঁর সন্দেহ তনু ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। পরে পরিস্থিতি সামলাতে তাঁকে খুন করা হয়।
সরকারি চাকরি বা সরকার বদলি করতে পারে এমন সব লোক বাদ দিয়ে একটি তদন্ত কমিটি হোক। মোজাহেরুল হক আশাবাদী যে চিকিৎসকদের সাক্ষাৎকার ও ডিএনএ টেস্ট দিয়ে ঘাতক ধরার সম্ভাবনা এখনো যথেষ্ট। আমি তাঁকে নাকচ করি বা না করি, যেদিকে জোর দিতে চাই সেটা হলো, ধরা যাক কমিটি হলো কিন্তু কিছুই পাওয়া গেল না। আমরা মনে করি, সেটা ধরে নিলেও তদন্ত করার যুক্তি বরং জোরালো হয়, দুর্বল হয় না তো বটেই। কারণ, আমাদের ইতিহাসে ময়নাতদন্ত কোনো আইন ছাড়াই যেমন চলেছে, তেমনি ময়নাতদন্ত নিয়ে আদর্শস্থানীয় কোনো তদন্তও হয়নি। তাই ময়নাতদন্ত-বিষয়ক লিটারেচারের দুর্ভিক্ষের মধ্যে আমরা বসবাস করি। অকালে চলে যাওয়া সাংস্কৃতিক কর্মী তনুর পবিত্র মৃতদেহের দোহাই, ময়নাতদন্তে নিরবচ্ছিন্ন দায়মুক্তি-সংস্কৃতির অবসান ঘটাক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
আমরা স্তম্ভিত বিস্ময়ে লক্ষ করি, দেশে গত ৪৪ বছর বেআইনিভাবে ময়নাতদন্ত চলছে এই তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পরও সরকার বলছে না যে, একটা আইন করব! মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ওই কমিটি করলে অবাক চোখে বলব ধন্যবাদ!
সূত্রঃ প্রথম আলে
(মিজানুর রহমান খান)