চিকিৎসক পুরো পরিবার নিয়েই নিখোঁজ

 

প্রতিবেদক, এবিসিনিউজবিডি,

ঢাকাঃ গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলায় ঘরছাড়া তরুণদের জড়িত থাকার বিষয়টি প্রকাশের পর নিখোঁজদের অনুসন্ধানে গিয়ে ঢাকার এক চিকিৎসকের পুরো পরিবার নিয়েই উধাও হওয়ার তথ্য মিলেছে।

নিখোঁজরা হলেন- ডা. রোকন উদ্দিন খন্দকার, পাসপোর্ট নম্বর- এএফ১০১৩০৮৮(৫০), তার স্ত্রী নাইমা আক্তার পাসপোর্ট নম্বর- বিসি০০০৬৯৩৭(৪৫), বড় মেয়ে রেজওয়ানা রোকন নাদিয়া, পাসপোর্ট নম্বর- বিসি০০৩৫১৯৮(২৩), ছেলে সাদ কায়েস, পাসপোর্ট নম্বর বিএফ০৪৮৬৬৪২(৩০) এবং ছোট মেয়ে রামিতা রোকন, পাসপোর্ট নম্বর- বিসি০০৪৫৩৩৯(১৫)এদের নিয়ে সিরিয়া হয়ে আইএস নিয়ন্ত্রিত এলাকায় পাড়ি জমিয়েছেন বলে পরিবারের ধারণা।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক রোকনুদ্দীন খিলগাঁও চৌধুরী পাড়ায় থাকতেন। তার স্ত্রী নাইমা ঢাকার বাইরের একটি কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ছিলেন।

একই পরিবারের ৫ সদস্য নিখোঁজ প্রসঙ্গে সোমবার রামপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘ঘটনাটি খিলগাঁও চৌধুরীপাড়ার ৪১১/বি নং বাসার। গত বছরের জুন মাসে ডা. রোকন উদ্দিন ও তার স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে তুরস্ক যান। এরপর থেকে তারা দেশে ফিরেননি।’

ওসি রফিকুল বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে বাড়িতে না থাকার বিষয়টি রহস্যজনক। এর সঙ্গে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে। বিষয়টি পুলিশের শীর্ষ পর্যায়কে জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে।’

নিখোঁজদের বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ইমিগ্রেশন) ফারজানা ইসলাম বলেন, ‘নিখোঁজ সবার বিষয়েই ইমিগ্রেশনের একটি দল কাজ করছে। তাদের প্রতিবেদন এখনও না আসায় এদের বিষয়ে (এই পরিবারের ৫ সদস্য) কিছু জানাতে পারছি না।’

সিরিয়া ও ইরাকের একটি অংশজুড়ে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়ে কাজ করছে ইসলামিক স্টেট (আইএস), বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গি হামলায় যে সংগঠনটির নাম আসছে।

সম্প্রতি গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলাকারী হিসেবে ঘরছাড়া অন্তত পাঁচ তরুণ-যুবকের জড়িত থাকার বিষয়টি প্রকাশের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে নিখোঁজ আরও ১০ যুবকের তথ্য জানানো হয়।

এরপর আরও নিখোঁজ আরও সাতজনের তথ্য আসে, যাদের পাঁচজনই ডা. রোকনুদ্দীনের পরিবারের সদস্য। অন্য দুজন হলেন তাওসীফ হোসেন এবং সেজাদ রউফ ওরফে অর্ক ওরফে মরক্কো।

ওই তথ্য পেয়ে চৌধুরীপাড়ায় গিয়ে জানা যায়, একটি পাঁচতলা ভবনের তৃতীয় তলার ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে থাকতেন রোকনুদ্দীন। বাড়িটি তার শ্বশুর খ্যাতিমান হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক প্রয়াত আলী আহমেদের।

ওই বাড়ির দেখভালকারী হেলাল উদ্দিন এবিসিনিউজবিডিকে বলেন, চার বছর আগে মৃত্যুর আগে আলী আহমেদ তার দুই মেয়েকে বাড়িটি দিয়ে গিয়েছিলেন। তার একজন রোকনুদ্দীনের স্ত্রী নাইমা।

রোকনুদ্দীনের গাড়িচালক হিসেবে আট বছর কাজ করেছিলেন জানিয়ে হেলাল বলেন, “প্রায় এক বছর আগে থেকে তাদের (রোকনুদ্দীনের পরিবার) কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।

“প্রথমে তারা মালয়েশিয়া যাবে, এরপর অন্য কোনো মুসলিম দেশে যাওয়ার কথা বলেছিল। এরপর থেকে আর কিছু জানি না।”

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেওয়া তালিকায় সাদ কায়েসকে ডা. রোকনুদ্দীনের ছেলে দেখানো হলেও হেলাল জানান, সাদ রিজওয়ানার স্বামী।

পুলিশ কর্মকর্তা মোস্তাফিজ বলেন, “রোকনুদ্দীনের বড় মেয়ে রেজওয়ানা ও তার স্বামী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করত, তবে শেষ করেনি। ছোট মেয়ে রামিতা পড়ত ভিকারুনিসানূন স্কুল ও কলেজে।”

গুলশান ও শোলাকিয়ায় নিহত দুই হামলাকারী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। তাদের মদদ দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়টির উপ-উপাচার্যকে। নিখোঁজদের মধ্যেও বেসরকারি এই বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থী রয়েছেন।

হেলাল জানান, নাইমা পরহেজগার ছিলেন। তবে তার দুই মেয়ে কয়েক বছর আগে থেকে হিজাব পরা শুরু করেছিলেন।

পাঁচ তলা ভবনটি ভাগাভাগি করে নেন নাইমা ও তার বোন হালিমা। নিচতলার আলী আহমেদ ফার্মেসিতে রোগীও দেখেন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক হালিমা।

তবে হালিমা ওই এলাকায় থাকলেও পৈত্রিক সূত্রে পাওয়ার ওই বাড়িতে থাকেন না বলে হেলাল জানান। ‘অনুমতি নেই’ জানিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকতেও দিতে চাননি তিনি।

পুলিশ কর্মকর্তা মোস্তাফিজ বলেন, “দেশ ছাড়ার পর পরিবারকে ফোন করে তারা (রোকনুদ্দীন) বলেছিল, আমরা একটি মুসলিম দেশে আছি, ভালো আছি। আমরা আর কোনোদিন বাংলাদেশে ফিরব না। তোমরা আমাদের যা আছে তা ভাগ-বাটোয়ারা করে বুঝে নাও।”

নাইমা সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যশোর সরকারি এম এম কলেজে শিক্ষকতা করছিলেন। ২০১৫ সালের ১৩ জুলাই ফ্রাস, জার্মানি ও মালয়েশিয়া যাবেন বলে ৪৬ দিনের ছুটি নিয়েছিলেন।

ছুটি শেষে হলেও নাইমা কর্মক্ষেত্রে আর যোগ দেননি বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন কলেজটির অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান।

তিনি বলেন, “বিষয়টি সেসময়কার প্রন্সিপাল নমিতা রানি বিশ্বাস শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছিলেন।”

নিখোঁজ তরুণ-যুবকদের তথ্য কিছু দিন ধরে মিললেও পুরো পরিবার ধরে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম জানা গেল।

এর আগে আরো ১০ জনের নিখোঁজ হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছিলো গণমাধ্যমে। তাদের কেউ এখনো ফিরে আসেননি।নিখোঁজরা হলেন- ঢাকার তেজগাঁওয়ের মোহাম্মদ বাসারুজ্জামান, বাড্ডার জুনায়েদ খান, পাসপোর্ট নম্বর-এএফ ৭৪৯৩৩৭৮, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নজিবুল্লাহ আনসারী, ঢাকার আশরাফ মোহাম্মদ ইসলাম, ব্রিটিশ পাসপোর্ট নম্বর-৫২৫৮৪১৬২৫, সিলেটের তামিম আহমেদ চৌধুরী, পাসপোর্ট নম্বর-এল ০৬৩৩৪৭৮ এবং এএফ ২৮৩৭০৭৬, ঢাকার ইব্রাহীম হাসান খান, পাসপোর্ট নম্বর-এএফ ৭৪৯৩৩৭৮, লক্ষ্মীপুরের এটিএম তাজউদ্দিন, পাসপোর্ট নম্বর-এফ ০৫৮৫৫৬৮, ঢাকার ধানমণ্ডির জুবায়েদুর রহিম, পাসপোর্ট নম্বর-ই ১০৪৭৭১৯, সিলেটের মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ ওজাকি, পাসপোর্ট নম্বর-টিকে ৮০৯৯৮৬০ ও মোহাম্মদপুরের জুন্নুন শিকদার, পাসপোর্ট নম্বর-বিই ০৯৪৯১৭২। এদের মধ্যে জুন্নুন শিকদার এবং বাসারুজ্জামানও নর্থ সাউথে পড়াশোনা করেছেন।

তবে গত বছর যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাংলাদেশি ১১ সদস্যের একটি পরিবার ঢাকা থেকে ফেরার পথে উধাও হয়ে যায়। তারা সিরিয়ায় আইএসের সঙ্গে ভিড়েছে বলে পরে তাদের স্বজনরা জানান।

 

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ