বঙ্গবন্ধুর ৪র্থ ছেলে কাদের সিদ্দিকী বেঁচে আছে

সাইফুর রহমান, প্রতিবেদক, এবিসিনিউজবিডি,

ঢাকা : বাংলাদেশে বিশ্ব ইতিহাসের এক জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞের কালো দিবস ১৫ আগস্ট।

পঁচাত্তরের এই দিনে কুচক্রিমহলের ইন্দনে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার প্রতিবাদে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃতে হাসতে হাসতে একদিনে প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছিলেন চার শতাধিক প্রতিরোধযোদ্ধা।

জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল কিছু বিপথগামী সেনা সদস্য। এই হত্যাযজ্ঞের সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওইদিন সকালেই কিশোরগঞ্জে প্রথম প্রতিবাদ মিছিল করেছিলেন কিছু দুঃসাহসী তরুণ। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা মিছিল করেছিলেন। পুলিশ তাদের ধরার জন্য ধাওয়া করেছিল। বহুদিন তরা আত্মগোপনেও ছিলেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহতের সংবাদ পেয়ে বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন।

১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বাঘা কাদের নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সমরনায়ক যিনি ভারতীয় বাহিনীর সাহায্য ব্যতিরেকেই ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথমার্ধে ঢাকা আক্রমণের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলেন। তাঁর পূর্ণ নাম আব্দুল কাদের সিদ্দিকী। তাঁকে বঙ্গবীর নামেও ডাকা হয়। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বাহিনী কাদেরিয়া বাহিনী তাঁর নেতৃত্বে গঠিত ও পরিচালিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য তাঁকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়।

তিনিই ১৬ আগস্ট ১৯৭৫ এর সকালে লিফলেট ছেড়ে ছিলেন সারা দেশে। এতে তিনি উল্লেখ করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ৩ ছেলে ঘাতকদের হাতে নিহত হলেও তার ৪র্থ ছেলে কাদের সিদ্দিকী বেঁচে আছে। এ হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান।

প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করতে করতে সীমান্ত দিয়ে তিনি ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। সেখানে থেকেই তিনি প্রতিরোধ কর্মসূচি চালিয়ে গেছেন। এ প্রতিরোধ কর্মসূচি চালানোর সময় তখন অনেক নেতাকর্মী জেল খেটেছেন।

13906722_1168459459843562_6246430487251545593_nবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর গোটা দেশ স্তম্ভিত হয়ে যায়। ঘাতকদের পক্ষে মেজর ডালিম বার বার রেডিওতে ঘোষণা করছিলেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর। অনেকেই আশা করেছিল এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ হবে। কিন্তু শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অধিকাংশই আত্মগোপন করেন।

তৎকালীন সেনা, বিমান, নৌবাহিনী প্রধান, বিডিআরের মহাপরিচালক, পুলিশের আইজিসহ সরকারি সব বাহিনীর প্রধান গিয়ে একে একে খুনিদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।

বঙ্গবন্ধু সরকারের শীর্ষ কয়েকজন মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এসব দেখে হতাশ হয়ে পড়েন সারা দেশের অগণিত মুজিবভক্ত।

তবে ছাত্রলীগ, যুবলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা কিছু একটা করার জন্য তত্পর হয়ে ওঠেন। নিজেদের মধ্যে তারা যোগাযোগ শুরু করেন।

তখন ২২ আগস্ট টাঙ্গইলের তৎকালীন জেলা গভর্নর বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম মাএ  ছয়জন সঙ্গী নিয়ে, যেমন তিনি ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার অন্তর্গত ধলাপাড়ায় ১৬ আগস্ট আবদুল কাদের সিদ্দিকী ধলাপাড়ার কাছাকাছি একটি স্থানে ছিলেন। তিনি খবর পান, তাঁদের তিনটি উপদল পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঘেরাও করেছে। তাঁদের সাহায্য করার জন্য তিনি সেখানে রওনা হন। আবদুল কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন ১০ জন। এই ১০জন সহযোদ্ধা নিয়ে পাকিস্তানিরা যে পথ দিয়ে পিছু হটছিল, সে পথে অবস্থান নেন তিনি। পাকিস্তানি সেনারা সংখ্যায় ছিল অনেক বেশি। তবে বিচলিত না হয়ে নিজের দুর্ধর্ষ প্রকৃতির সহযোদ্ধাদের নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। একটা ২০ মিনিটে পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের অ্যাম্বুশে প্রবেশ করে এবং চল্লিশ গজের মধ্যে আসামাত্র কাদের সিদ্দিকী এলএমজি দিয়ে প্রথম গুলি শুরু করেন। একই সময় তাঁর সহযোদ্ধাদের অস্ত্রও গর্জে ওঠে। নিমেষে সামনের কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। বাকি সেনারা প্রতিরোধে না গিয়ে পালিয়ে যেতে থাকে। এ দৃশ্য দেখে কাদের সিদ্দিকী উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে এলএমজি দিয়ে পলায়নরত পাকিস্তানি সেনাদের লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকেন। তাঁর সহযোদ্ধারাও উঠে দাঁড়িয়ে গুলি শুরু করেন, এবং সেদিন তাদেরকে পরাজিত করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রায় ৪০ জন হতাহত হয়।

220px-কাদেরিয়া_বাহিনীর_অস্ত্র_জমাদানতেমনি ১৯৭৫ এ ও তিনি জামালপুর সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। সেখানে গিয়ে ‘হত্যাকারী অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে’ সশস্ত্র প্রতিরোধের ডাক দেন তিনি। তার আহ্বানে টাঙ্গাইলসহ সারা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধা এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগের কিছু নেতা-কর্মী ভারতে গিয়ে যোগ দেন কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে। পঁচাত্তরের অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে এ বাহিনীর একটি গ্রুপ যমুনা নদী হয়ে নৌপথে প্রবেশ করে। সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার নিশ্চিন্তপুর চরে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে তাদের সম্মুখযুদ্ধ হয়।

এতে বগুড়া জেলা যুবলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল খালেক খসরু নিহত হন। প্রচণ্ড যুদ্ধের মুখে তার লাশ সহযোদ্ধারা যমুনায় ভাসিয়ে দিতে বাধ্য হন। পরে তারা সেখান থেকে পিছু হটে টাঙ্গাইল হয়ে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট সীমান্ত এলাকায় চলে যান। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে পথে পথে চলে বন্দুকযুদ্ধ। এর মধ্যেই নিজেদের জীবন বাঁচিয়ে, সীমিত অস্ত্রশস্ত্র রক্ষা করে প্রতিরোধযোদ্ধারা পৌঁছে যান হালুয়াঘাটের পাহাড়ি সীমান্তে।

এরপর গঠন করেন জাতীয় মুক্তিবাহিনী। হালুয়াঘাট সীমান্তে গিয়ে গোবড়াকুড়া গ্রামে আদিবাসী গারো প্রবোধ দিওর বাড়িতে প্রতিরোধব্যূহ তৈরি করে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করা হয়। তখন থেকে দলে দলে আদিবাসী যুবকরা সেই প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগ দেন।

বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ভারতের তিন মাইল ভিতরে চান্দুভুঁই নামক স্থানে স্থাপন করা হয় প্রতিরোধযোদ্ধাদের হেডকোয়ার্টার। বাহিনীর নামকরণ করা হয় ‘জাতীয় মুক্তিবাহিনী’। এ বাহিনীর লোগো ও ব্যাজ নির্বাচন করা হয় বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ নির্বাচিত হন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। এ ছাড়া ৩৬ জনকে এ বাহিনীর বিভিন্ন কমান্ডার করা হয়। এরা হলেন— সুনীল কুমার গুহ, ফারুক আহমেদ, আ হ সেলিম তালুকদার, সৈয়দ নূরুল ইসলাম, আরিফ আহেমদ দুলাল, কবিরুল ইসলাম বেগ, সাইদুর রহমান মহারাজ, খোরশেদ আলম, আর ও মাহবুব আহমেদ, আলী হোসেন, মীর দেলোয়ার, আবদুল বাতেন, জয়নাল আবেদীন, বিজন সাহা, নাসিম ওসমান, অলোক দত্ত, দীপংকর তালুকদার, মো. আবদুল্লাহ, পংকজ আজিম, আবদুল হক, জিতেন ভৌমিক, বাবুল হক, লুত্ফর রহমান, মো. আমান উল্লাহ, তমছের আলী, আলবার্ট ম্রং, গাজী লুত্ফর, সুকুমার সরকার, হাসেমী মাসুদ জামিল, জগলুল পাশা, আবদুল হালিম, এম এ মান্নান, আবদুর রব, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, এম এ জলিল ও প্রবোধ দিও।

শুরু হলো যুদ্ধ । এ যুদ্ধ শুধু প্রতীকী যুদ্ধ ছিল না, বরং ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা জেলার সীমান্তবর্তী অনেক বড় এলাকা দখল করে নিয়েছিলেন প্রতিরোধযোদ্ধারা। সীমান্তবর্তী এলাকার পাঁচটি বিডিআর ক্যাম্প ও দুটি থানা দখল করে নিয়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এ যোদ্ধারা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে একাধিকবার সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তারা। যুদ্ধে চার শতাধিক প্রতিরোধযোদ্ধা শহীদ হন। তারা ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে হাসতে হাসতে প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছিলেন জাতির জনক হত্যার প্রতিবাদে।

13770431_1161002570589251_5005971508968588692_nমেঘালয় সীমান্তের ভিতরে ঘন বনাঞ্চলঘেরা দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল চান্দুভুঁইতে গড়ে ওঠে সদর দফতর। সেখানে বসে পুরোটা সময় সর্বাধিনায়কের নেতৃত্ব দেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। প্রধান অর্থনির্বাহী ছিলেন গারো আদিবাসী চিত্তরঞ্জন সাংমা। প্রধান নিয়োগ কর্মকর্তা কামারখালীর অধিবাসী আবদুল হক। একসময় সেক্টর হেডকোয়ার্টার স্থাপন করা হয় নেত্রকোনার দুর্গাপুর থানার ভবানীপুরে।

ওই এলাকা ছিল বাংলাদেশের ছিটমহল। সেখানে যেতে হলে ভারতীয় সীমানা পার হতে হতো বলে বাংলাদেশি সেনা, বিডিআর কিংবা পুলিশের কারও পক্ষে সেখানে পৌঁছা ছিল অসম্ভব। সেক্টর জিওসি হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন টাঙ্গাইলের সেলিম তালুকদার। সেকেন্ড ইন কমান্ড প্রশান্ত কুমার সরকার। কোয়ার্টার গার্ডের অধিনায়ক ছিলেন শরীফুল ইসলাম খান আর ডিফেন্স কমান্ডার সাইদুর রহমান। হেডকোয়ার্টারের অধীনে বাংলাদেশের ভিতর বেশ কিছু সাব-সেক্টর স্থাপন করা হয়েছিল।

ঐতিহাসিক ভাবেই সত্য। অকুতভয় সৈনিক বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী এর অবদান বাংলার দামাল সন্তানদের কাছে গেরিলা যুদ্ধের অসাধারণ কৃতিত্ব, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুদৃঢ় নেতৃত্বে আস্থাশীল হয়ে কাদেরীয়া বাহিনী গঠন করে সাহসী নেতৃত্ব অবস্থান নিয়ে ইতিহাসের পাদপীঠে স্থান করেছেন।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ