ঝড়ে গেল বিএনপির আরেক দুঃসময়ের কাণ্ডারি হান্নান শাহ

প্রতিবেদক, এবিসিনিউজবিডি,

ঢাকাঃ বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি… রাজিউন)।

২৭ সেপ্টেম্বর (মঙ্গলবার) ভোরে সিঙ্গাপুরের র‌্যাফেলস হার্ট সেন্টারে তার মৃত্যু হয়। তার বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। স্ত্রী নাহিদ হান্নান, দুই ছেলে শাহ রেজাউল হান্নান ও শাহ রিয়াজুল হান্নান এবং একমাত্র মেয়ে শারমিন হান্নান সুমিকে রেখে যান তিনি।

২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় খালেদা জিয়া যখন কারাগারে, সে সময় বিএনপিকে সংগঠিত রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। দলের সংস্কারপন্থি অংশের বিরুদ্ধে সে সময় গণমাধ্যমেও সোচ্চার ছিলেন তিনি।

সিঙ্গাপুরে অবস্থানরত হান্নান শাহের ছোট ছেলে শাহ রিয়াজুল হান্নানের বরাত দিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস উইংয়ের সদস্য শামসুদ্দিন দিদার বলেন, মঙ্গলবার ভোরে সিঙ্গাপুরের র‌্যাফেলস হার্ট সেন্টার হাসপাতালের মারা যান বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য।

হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সেখানে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তিনি। হান্নান শাহর বড় ছেলে রেজাউল হান্নান জানান, সিঙ্গাপুরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বুধবার সন্ধ্যায় তার বাবার মরদেহ ঢাকায় নিয়ে আসা হবে।

বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় মহাখালী ডিওএইচএস মসজিদে, সাড়ে ১১টায় সংসদ ভবনের দণি প্লাজায় এবং জোহরের পর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে তার জানাজা হবে। ওই দিন হান্নান শাহের মরদেহ সিএমএইচের হিমঘরে রেখে শুক্রবার সকালে সড়কপথে গাজীপুরে নিয়ে যাওয়া হবে। সকাল ৯টায় জয়দেবপুর রাজবাড়ী মাঠে, সাড়ে ১০টায় কাপাসিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এবং জুমার পর হান্নান শাহর নিজ গ্রাম চালা বাজার উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জানাজা শেষে বাবার কবরের পাশেই তাকে দাফন করা হবে।

গত ৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মহাখালী ডিওএইচএসের বাসা থেকে আদালতে হাজিরা দিতে বের হওয়ার সময় হান্নান শাহ হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তাকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়। পরে চিকিৎসকদের পরামর্শে ১১ সেপ্টেম্বর এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তাকে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়। সেখানে তার হৃদযন্ত্রে অস্ত্রোপচার (এনজিওপ্লাস্টি) করা হয়েছিল।

আ স ম হান্নান শাহর মৃত্যুতে ৪ দিনের শোক ঘোষণা করেছে বিএনপি। মঙ্গলবার শুরু হওয়া শোক কর্মসূচি চলবে আগামী শুক্রবার পর্যন্ত। এ সময় দলের নয়াপল্টনস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারা দেশে দলীয় কার্যালয়গুলোয় দলীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে এবং শোকসূচক কালো পতাকা উত্তোলন করা হবে। আগামী শুক্রবার সারা দেশে দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। হান্নান শাহর মৃত্যুতে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে শোকবই খোলা হয়েছে। সকাল ১১টা থেকে বিএনপি নেতাকর্মী ও সমর্থকদের স্বারের জন্য তা আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত উন্মুক্ত থাকবে।

এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আ স ম হান্নান শাহর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। গতকাল মঙ্গলবার এক শোক বার্তায় রাষ্ট্রপতি প্রয়াত বিএনপির এই নেতার রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান।

হান্নান শাহর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। শোকবার্তায় তিনি বলেন, দেশ ও জাতির যে কোনো প্রয়োজনে তিনি (হান্নান শাহ) অসম সাহস ও দেশপ্রেমে দীপ্ত হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে। আজীবন তিনি যোদ্ধা সেনানায়কের ভূমিকা পালন করেছেন। খালেদা জিয়া বলেন, হান্নান শাহর মৃত্যুতে শুধু বিএনপিই তিগ্রস্ত হয়নি, দেশ হারাল জাতীয় স্বার্থার এক দেশপ্রেমিক অধিনায়ককে। জাতি হারাল এক সাহসী সন্তানকে। এ ছাড়া হান্নান শাহর মৃত্যুতে শোক প্রকাশে করেছেন ২০-দলীয় জোটের শরিক দলগুলো।

হান্নান শাহর মৃত্যুর খবর পেয়ে সকালে মহাখালী ডিওএইচএসে হান্নান শাহর বাসায় যান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি তার স্ত্রী নাহিদ হান্নান ও বড় ছেলে শাহ রেজাউল হান্নানসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাদের সমবেদনা জানান।

১৯৪১ সালের ১১ অক্টোবর গাজীপুরের কাপাশিয়ার ঘাগটিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন হান্নান শাহ। তার বাবা ফকির আবদুল মান্নান ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। হান্নান শাহর ছোট ভাই শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি। ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন পাওয়া হান্নান শাহ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় অন্য বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে দেশে ফিরে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে একদল সেনাসদস্যের হাতে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে রাঙ্গুনিয়া থেকে তার মরদেহ ঢাকায় নিয়ে আসেন তখনকার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসম হান্নান শাহ। এইচএম এরশাদ সরকারের সময় তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যান।

অবসরের পর এরশাদের সময়ে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পেয়েছিলেন হান্নান শাহ। ১৯৮৩ সালে ওই পদ ছেড়ে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিতে যোগ দেন। শুরুতে মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক, ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত দলের সাংগঠনিক সম্পাদক (ঢাকা বিভাগ) ও ১৯৯৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্যের দায়িত্ব পালন করেন। হান্নান শাহ ১৯৯১ সালের নির্বাচনে গাজীপুর-৪ আসন (কাপাসিয়া) থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে তাকে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। এর পর ২০০৯ সালে বিএনপির পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে দলের সর্বোচ্চ ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য করা হয় হান্নান শাহকে।

নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় কয়েকবার কারাগারে যেতে হয়েছিল আসম হান্নান শাহকে। বর্তমান সরকারের সময়ও তাকে কারা ভোগ করতে হয়েছে। নাশকতাসহ বিভিন্ন অভিযোগে ৩০টির বেশি মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

 

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ