আদালতকে অগ্রাহ্য করেই জেলা পরিষদ নির্বাচন

পরোক্ষ ভোটে জেলা পরিষদ গঠনের ধারাটি কেন অসাংবিধানিক বলে গণ্য হবে না, সেই মর্মে সরকারের ওপর রুল জারি থাকলেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা সরকারের কর্তাব্যক্তিরা হয় বিষয়টি সম্পর্কে জানেন না, নয়তো উদাসীন ছিলেন। একটি জাতীয় দৈনিকের  অনুসন্ধানে জানা যাচ্ছে, ২০০৮ সালের ৩১ জানুয়ারি হাইকোর্ট বিভাগের একটি দ্বৈত বেঞ্চ তাঁর আদেশে বলেছিলেন, বিষয়টি সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মৌলিক অধিকারের সঙ্গে জড়িত। তবে, ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির জরুরি অবস্থাকালীন ক্ষমতাবিধির ২ নম্বর আদেশের কারণে বিষয়টি তখন আদালতের কার্যতালিকা থেকে বাদ রাখা হয়। বলা হয়, জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়ার পর এই মামলা পুনরায় আদালতের সামনে পেশ করতে হবে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, মামলাটি হয়েছিল ২০০০ সালে এবং ওই বছরের ১৯ জুলাই বিচারপতি মাইনুর রেজা চৌধুরী এবং বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ তিন সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দেওয়ার জন্য সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। কিন্তু গত ১৬ বছরেও রাষ্ট্রপক্ষ ওই রুলের কোনো জবাব দেয়নি। অন্যদিকে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের সাত বছর অতিক্রম হলেও এই রিট মামলা (নং ৩৭৮৩/২০০০) কখনো হাইকোর্ট বিভাগের কোনো বেঞ্চে উপস্থাপন করা হয়েছে বলে আদালতের নথিতে কোনো প্রমাণ মেলেনি। ইতিমধ্যে রুলদানকারী দুই বিচারপতি প্রধান বিচারপতি হয়ে অবসরে গেছেন। বিচারপতি চৌধুরী ২০০৪ সালে মারা গেছেন।

ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, ‘যদিও এটা ঠিক যে ওই রিট মামলায় শুধু রুল জারি করা হয়েছিল। ২০০০ সালের জেলা পরিষদ আইনের ওপর কোনো স্থগিতাদেশ বা অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ জারি করা হয়নি। তদুপরি আইনের চোখে বিষয়টি সাবজুডিস বা বিচারাধীন রয়ে গেছে। আমি মনে করি, বিষয়টির সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রশ্ন জড়িত। এই রুলটির শুনানি সাপেক্ষে নিষ্পত্তি করা ছাড়া জেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠান কাঙ্ক্ষিত নয়।’

জানতে চাওয়া হলে আইন ও বিচারমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল বলেন, ‘আমি এই মামলার নথি নিশ্চয়ই খতিয়ে দেখব।’ তিনি আরও বলেন, ‘যেহেতু অন্তর্বতীকালীন কোনো বাধানিষেধ নেই, তাই আমি মনে করি, নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো বাধা নেই। যথাসময়ে নির্বাচন সম্পন্ন হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। নির্বাচনের মাধ্যমেই গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়।’

সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদের চেম্বার ওই রিট মামলাটির নথি খুঁজে পেতে সহায়তা করে। তবে প্রশ্নের জবাবে তিনি ২০০০ সালে নির্বাচকমণ্ডলীর বৈধতা প্রশ্নে বিএনপি হাইকোর্টে রিট দায়ের করা সত্ত্বেও ক্ষমতায় গিয়ে সে বিষয়ে কোনো প্রকারের পদক্ষেপ না নেওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করেন। তাঁর কথায়, ‘এটা বিএনপি সরকারের অনেক ব্যর্থতার অন্যতম। আমরা কেউই গণতন্ত্রের সঠিক রীতিনীতি মেনে চলিনি।’ তিনি মনে করেন, বিষয়টি এখনো আইনের চোখে সাবজুডিস বা বিচারাধীন রয়ে গেছে। আদালতে এর নিষ্পত্তি হওয়া উচিত।

জানতে চাওয়া হলে গত বৃহস্পতিবার অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিষয়টি বিচারাধীন থাকলেও যেহেতু কোনো অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা ছিল না, তাই নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো বাধা নেই।

২০০০ সালের ৩ জুলাই জেলা পরিষদ বিল পাস হওয়ার পরে বিএনপির পক্ষ থেকে রিট মোকদ্দমাটি দায়ের করেছিলেন লক্ষ্মীপুর থেকে নির্বাচিত সাংসদ আইনজীবী খায়রুল এনাম। তিনি বলেছেন, ‘১৯৯১ ও ১৯৯৬-এর সংসদে নির্বাচিত হওয়ার পর আমি রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছি। ১৯৬২ ও ১৯৬৪ সালে জগন্নাথ কলেজ ছাত্রলীগের সহসাধারণ সম্পাদক ছিলাম। তবে হাইকোর্ট বিভাগের একজন আইনজীবী হিসেবে আমি আশা করব, আমার দায়ের করা রিটের শুনানি ব্যতিরেকে নির্বাচন কমিশন জেলা পরিষদ নির্বাচন করা থেকে বিরত থাকবে।’ তিনি জানিয়েছেন যে বিএনপির সিদ্ধান্তে ওই রিটটি দায়ের করা হয়েছিল।

মওদুদ আহমদ ২০০০ সালের শুনানিতে বলেছিলেন, পরোক্ষ ভোটে জেলা পরিষদের নির্বাচনের বিধান সংবিধানবিরোধী। কারণ, সংবিধানে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরই স্থানীয় সরকার পরিষদের সব স্তর পরিচালনা করার বিধান রয়েছে। উল্লেখ্য, জেলা পরিষদ বিলের ৮২ ধারায় প্রশাসক নিয়োগের বিধান আছে এবং ওই রিটে তারও বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল। বিএনপি জেলা পরিষদে রাজনৈতিক প্রশাসক নিয়োগের বিরোধিতা করে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছে। অথচ তারা তাদের দায়ের করা রিটের শুনানি করতে উদ্যোগী হয়নি। বর্তমান সরকার তেমন কোনো জটিলতার সম্মুখীন হওয়া ছাড়াই দলীয় প্রশাসক দিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে জেলা পরিষদ চালানোর সুযোগ পেয়েছে।

রিট আবেদনে যুক্তি দেখানো হয়েছিল, পরোক্ষ ভোটে সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জেলা পর্যায়ে প্রশাসনিক একাংশ পরিচালনার ব্যবস্থা চালু করা সংবিধানের ৯, ১১ ও ৬০ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। এ ছাড়া সর্বজনীন ভোটাধিকারকে অস্বীকার করাও সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে উল্লেখ করা হয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০১ সালের ৩০ ডিসেম্বর এই রিট মামলার সংশ্লিষ্ট পক্ষকে নোটিশ জারির কাজ সম্পন্ন করা হয় এবং মামলাটি শুনানির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল। কিন্তু সেই শুনানি আর কখনো হয়নি।

উল্লেখ্য যে ২০০০ সালের ৬ জুলাই জাতীয় সংসদে জেলা পরিষদ আইন পাস হয়েছিল। বিএনপি সংসদে অনুপস্থিত ছিল। বর্তমান ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী জাতীয় পার্টির সাংসদ হিসেবে নির্বাচকমণ্ডলী প্রবর্তনের বিরোধিতা করে বলেছিলেন, সরাসরি ভোটে নির্বাচন হতে হবে। কারণ, একদিকে আমরা গণতন্ত্রের কথা বলব, অন্যদিকে জনগণের ভোটের অধিকার সংকুচিত করব তা হয় না। জাতীয় পার্টি (মিজান-মঞ্জু) ওই বিল পাসে বিরোধিতা করেছিল।

২০০০ সালের আইনের ৪ ধারার ২ উপদফায় বলা হয়েছিল, একজন চেয়ারম্যান ১৫ জন সদস্য এবং সংরক্ষিত আসনের ৫ জন মহিলা সদস্য নিয়ে জেলা পরিষদ গঠিত হবে এবং তাঁরা নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে নির্বাচিত হবেন। ১৭ ধারায় বলা আছে, প্রতিটি জেলার অন্তর্ভুক্ত সিটি করপোরেশন, যদি থাকে, এর মেয়র ও কাউন্সিলরগণ, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলরগণ এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যগণ সমন্বয়ে উক্ত জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য নির্বাচনের জন্য নির্বাচকমণ্ডলী গঠিত হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডের জন্য নির্বাচকমণ্ডলী কর্তৃক প্রণীত একটি তালিকা থাকবে।

এদিকে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইউনুস আলী আকন্দ গত ২৭ নভেম্বর বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে নতুন করে আরেকটি রিট আবেদন করেছেন। ইউনুস আলী আকন্দ বলেন, ‘আমি ২০০০ সালের জেলা পরিষদ আইনের ৪ ধারা ২ উপদফা এবং ১৭ ধারা এবং ২০১৬ সালের সংশোধনীর ৫ ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেছি। এখন যদি দেখা যায়, ২০০০ সালে হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ ২০০০ সালের জেলা পরিষদ আইনের একই ধারা চ্যালেঞ্জ করার পরিপ্রেক্ষিতে রুল জারি করেছেন, তাহলে আমি যে রিট দায়ের করেছি, সেটির শুনানির সঙ্গে আগে দায়ের করা রিটের শুনানি একসঙ্গে চলবে।’ তিনি বলেন, কোনো একটি আইনের সাংবিধানিক বৈধতা প্রশ্নে একাধিক রিট হতে পারে। কিন্তু রেওয়াজ অনুযায়ী শুনানি হবে একত্রে এবং তার রায়ও হবে একটি।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ