দর্শককে শ্রদ্ধা না করুন, দয়া করুন
বিনোদন ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: সংসারের সুখের জন্য দুইখানা জিনিস লাগবেই। পয়লায় চুলা, দোসরায় হলো টেলিভিশন। এক জরিপে দেখা গেছে, টেলিভিশনের কারণে স্বামী-স্ত্রীতে কথা হয় কম; তাই ঝগড়াও হয় কম। কনেপক্ষও আগে সংসারের সুখ কামনায় মেয়ের সঙ্গে একখানা টেলিভিশন দিয়ে দিত। কিন্তু সেটা বিটিভির আমল; যখন দর্শক ছিল একমুখী। সেটা ছিল এক দেশ, এক পরিবার, এক টেলিভিশন—এক ও অভিন্নজাতীয় দর্শক। সে আমলে টেলিভিশন ছিল পরিবারের প্রধান ‘ব্যক্তি’। তাকে ঘিরে সবাই বসে থাকত। অতিথি এলেও বসানো হতো টিভি রাখার ঘরেই।
কিন্তু সে দিন আর নেই। এখন চ্যানেল বহু আর দর্শকও বহুমুখী। ফলে টিভির রিমোটের দখল নিয়ে সংসারে অশান্তিও বেড়েছে। স্ত্রী স্টার জলসা দেখবেন বলে স্বামী খেলা বা টক শো উপভোগ করতে পারছেন না। সন্তানদেরও রয়েছে নিজস্ব পছন্দ। যাঁরা পারেন, প্রত্যেকের জন্য আলাদা টিভিসহ ঘরের ব্যবস্থা করে গৃহযুদ্ধ থামান। কিন্তু যাঁদের সে উপায় নেই, তাঁদের টেলিভিশন আর জীবন এক হয়ে যায়। যখন টিভিতে চলে হিন্দি সিরিয়ালের কূটনামির গৃহদাহ, তখন বঞ্চিত দর্শক বাস্তবেই গৃহদাহ চালু করেন। একসময় সংসার সুখের হতো যে টিভির গুণে, এখন সেটাই অশান্তির কারণ। টিভি দেখা নিয়ে স্বামী-স্ত্রীতে বিবাহবিচ্ছেদ থেকে শুরু করে গ্রামবাসীর মধ্যে মারামারির ঘটনাও শোনা যায়। বিনোদন, অবসর, সংস্কৃতিচর্চা—সবই যখন টিভিকেন্দ্রিক, তখন টিভিতে কী দেখায় বনাম কী দেখতে চাই, তা অবশ্যই বিতর্কের বিষয়।
সম্প্রতি এই গৃহদাহ জাতীয় স্তরে উঠে এসেছে। দেশের টেলিভিশনের শিল্পী ও কলাকুশলীদের বড় অংশটাই হঠাৎ ‘অস্তিত্ব’সচেতন হয়ে উঠলেন এবং জেগে উঠে দেখতে পেলেন সে অস্তিত্বের সামনে বেজায় বিপদ। তাঁরা নাটক করেন ও বানান বটে, কিন্তু দর্শক তাঁদের নিচ্ছে না। দর্শক নিচ্ছে বাংলায় তরজমা করা বিদেশি সিরিয়াল। সুলতান সুলেইমান নামের এক তুর্কি সিরিয়ালের বাংলা ‘ডাবিং’ প্রচার করে একটি চ্যানেল লাভবান হয়ে গেল। দেখাদেখি আরও আরও চ্যানেল সেই পথ ধরল। আসলেই তো সর্বনাশ। সব দেশি চ্যানেলে যদি বিদেশি ধারাবাহিক চলে, তাহলে দেশের কালচার ইন্ডাস্ট্রির তো বেকার হওয়ার জোগাড়!
কিন্তু আসলেই কি তাই? রাধা দিনে থাকত ঘরে, সন্ধ্যার পর চলে যেত অভিসারে। তেমনি আমাদের অধিকাংশ দর্শক সন্ধ্যা হলেই পরবাসী হতেন। শরীর ঘরে থাকলেও মন চলে যেত অজস্র হিন্দি চ্যানেলের সিরিয়াল, শো, সিনেমা ইত্যাদিতে। এভাবে আকাশ-সংস্কৃতির যুগে বিনোদনের আকাশপথ আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল। যে পথে দর্শক, বিজ্ঞাপনও সে পথেই যাবে। প্রায় এক হাজার কোটি টাকার বিজ্ঞাপন–বাণিজ্যের চার শ কোটিই এখন ওই সব বিদেশি চ্যানেলের খোরাক। এদিকে ঘরে ঘরেও চালু হলো হিন্দি বুলি। অনেকে বললেন, হিন্দি সিরিয়ালগুলোর কুটিল কাহিনি সংসারের বিষ। রিয়েলিটি শোর খোলামেলা নাচ–গান আর শিশুদের দিয়ে অশিশুসুলভ তরল বিনোদন আমাদের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে গরল করে ফেলছে। আজকাল শিশু-কিশোর-যুবাদের আড্ডার ভাষাও দেখা যায় হিন্দি। একজন বিদেশি বাংলাদেশে বসে এসব অনুষ্ঠান দেখে ভেবে বসলেন, এটাই আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি!
বিশ্বায়নের যুগে সংস্কৃতি যেমন বাজার, তেমনি রাজনীতিরও ময়দান। পাকিস্তান আমলে বাংলার জান-মান-অধিকারের লড়াইটা সংস্কৃতির জমিনেই শুরু হয়। সংস্কৃতি পণ্যও বটে। টেলিভিশনের রয়েছে পণ্যে আসক্ত করার মারাত্মক ক্ষমতা। বিশ্বে মার্কিন প্রাধান্য জারি রাখায় হলিউড খুব কাজে লাগে। একই ভূমিকা বলিউডেরও।
এই হুমকি নিয়ে আজকের সরব শিল্পীসমাজ বরাবরই নীরব। তাঁদের দুশ্চিন্তা নিজেদের পেশাগত অস্তিত্ব নিয়ে। হিন্দি চ্যানেলই তাঁদের দর্শকহারা করলেও সে ব্যাপারে এখনো তাঁদের রা নেই। মন টানে না এমন অযত্নে বানানো জিনিস মানুষ দেখবে কেন? দেশে প্রতিভাবান শিল্পী, অভিনেতা, গায়ক, সুরকার—সবই আছে। তাঁরাই হতে পারতেন উপযুক্ত বিনিয়োগ। বিশ্বায়নের খোলাবাজারের দিলখোলা হাওয়ার মধ্যে প্রতিযোগিতা ছাড়া উপায় কই? কিন্তু একশ্রেণির টিভি কর্তৃপক্ষ, বিজ্ঞাপন এজেন্সি ও শিল্প-সওদাগরের কারণে আমরা সোনা ফেলে রাংতার কারবার করে করে বিনা যুদ্ধেই বিনোদনের আকাশ ছেড়ে দিচ্ছিলাম। তারই ফল বিদেশি কালচার-ইন্ডাস্ট্রির হাতে দেশীয় কালচার ইন্ডাস্ট্রির পরাজয়।
সারা ভারত না হয় বাদই দিলাম, ভারতের বাংলাভাষী তিনটি রাজ্যেও কেন আমরা আমাদের চ্যানেল দেখাতে পারি না? যেখানে মাত্র দেড় লাখ টাকা ফি দিয়ে যেকোনো ভারতীয় চ্যানেল বাংলাদেশের ঘরে ঘরে ঢুকতে পারে, সেখানে বাংলাদেশি চ্যানেলের জন্য তারা ফি ধার্য করেছে পাঁচ কোটি টাকা? আমাদের শাকিব খান, আমাদের সালমা, আমাদের মোশাররফ করিম তো কলকাতায় জনপ্রিয়। আমাদের জেমসসহ আরও আরও শিল্পী বলিউডে গিয়ে গান শোনান। অবরুদ্ধ রাখার পরও সেখানে আমাদের দর্শক-শ্রোতা আছে। ঢাকার নাটকের খুব কদর ছিল কলকাতায়। কিন্তু আমাদের সরকার ভারতে আমাদের বিনোদন-শিল্পের বাজার তৈরিতে কিছু করেনি। আগে এটা নিয়েই তো কথা বলা দরকার ছিল, তাই না?
দরকার ছিল হুঁশ ফেরানোর। যেমন খুশি তেমন জিনিস দেব, দর্শক তা গিলবে কেন? রিমোট কন্ট্রোল হাতে চ্যানেল পাল্টানোর ওইটুকু স্বাধীনতা দর্শক ছাড়বে কেন? এরই মধ্যে বাংলায় ডাব করা তুর্কি সিরিয়াল সুলতান সুলেইমান অন্তত দর্শকদের দেশি ভাষা ও দেশি চ্যানেলে টেনে এনেছিল। কিন্তু এটাও সমাধান নয়। একযোগে সব চ্যানেলে ডাব করা বিদেশি চ্যানেল চলতে পারে না। মানের বাছাই লাগবে; সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের বিচার লাগবে। এর জন্য নীতিমালা লাগবে। আমরা নিয়ন্ত্রণের পক্ষে নই, উদার ও সৃষ্টিশীল নীতিমালার পক্ষে। বিষয়টা গুরুতর। কেননা, বেশির ভাগ মানুষ ভূত-ভবিষ্যৎ দেখে না, টেলিভিশন দেখে।
আমরা কি বই অনুবাদের বিপক্ষে? তাহলে চলচ্চিত্র বা নাটক অনুবাদের বিপক্ষে থাকব কেন? আমাদের শিল্পীরাই কি মঞ্চনাটকে বিদেশি নাটকের অনুবাদ সংলাপে অভিনয় করেন না? আমাদের টেলিভিশনেই কি জনপ্রিয় ম্যাকগাইভার, আলিফ লায়লা, টিপু সুলতান-এর চেয়ে জনপ্রিয় হয়নি হূমায়ুন আহমেদের সমস্ত নাটক? আমরাই কি সৃষ্টি করিনি ‘নতুন কুড়ি’র মতো অসাধারণ রিয়েলিটি শো? দর্শক মাত করা ‘ইত্যাদি’ কিংবা আজকের আয়নাবাজি সিনেমাই প্রমাণ, ভালো কাজের স্বীকৃতি আছে। শিশুদের জন্য ‘মিনা কার্টুন’ কি বাংলায় ডাব করে দেখানো ভালো হয়নি? একসময় সপ্তাহের প্রতিটি দিন একটা না একটা মনকাড়া অনুষ্ঠান ছিলই দেশি টিভিতে। বিদেশি অনুষ্ঠানের সঙ্গে দেশের মেধাবী পরিচালকদের মধ্যে এমন প্রতিযোগিতার দিনগুলোতে দর্শকদের সন্ধ্যার সময়টা সুন্দর কাটত।
মূল সমস্যা দেশি চ্যানেলের সঙ্গে বিদেশি চ্যানেলের। মূল সমস্যা নাট্যকার, স্ক্রিপ্ট লেখক ও শিল্পীদের যথাযথ বাজেট দিতে কৃপণতা করার। মূল সমস্যা বিজ্ঞাপনের কাঠি হাতে শিল্পীদের ফরমাশ দেওয়ার মানসিকতার। মূল সমস্যা প্রতিভা, নিষ্ঠা ও গবেষণার অভাব। টিভিগুলো অল্প বিনিয়োগে বেশি ব্যবসা করতে চাইলে তো হবে না। আমাদের বিনোদনজগৎ কি নতুন বাস্তবতায় কী দেখাতে হবে এবং কী কীভাবে দেখানো যায়, তা নিয়ে সত্যিকারভাবে ভেবেছে?
দর্শককে দয়া করুন, দর্শক আপনাদের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও সমৃদ্ধি—সব দেবে।