হঠাৎ নিখোঁজ চার তরুণ
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: রাজধানীর বনানী এলাকা থেকে একসঙ্গে চার তরুণ নিখোঁজ হয়েছেন। বৃহস্পতিবার হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার এই ঘটনাকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা। জঙ্গিবাদে যুক্ত হতে এই তরুণেরা ঘর ছেড়েছেন কি না, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
তবে নিখোঁজ চারজনের মধ্যে তিনজনের অভিভাবকেরা বলছেন, তাঁদের সন্তানেরা খুব সাধারণ পর্যায়ে ধর্ম-কর্ম করতেন, শুক্রবার মসজিদে যেতেন। সন্দেহ করার মতো কিছু চোখে পড়েনি।
নিখোঁজ চারজন হলেন সাফায়াত হোসেন, জাইন হোসেন খান (পাভেল), মেহেদি হাওলাদার ও মো. সুজন। তাঁদের বয়স ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। তাঁদের মধ্যে সাফায়াত ও জাইন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মেহেদি বরিশালের বিএম কলেজের ছাত্র। আর সুজন ড্যাফোডিল থেকে তথ্যপ্রযুক্তিতে কোর্স করে একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন।
১ ডিসেম্বর চারজন নিখোঁজ হন। পাঁচ দিনেও তাঁদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এই ঘটনায় বনানী থানায় দুটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছে। সাফায়েত, জাইন ও সুজনের নিখোঁজের বিষয়ে একটি জিডি করেছেন জাইনের বাবা ইসমাইল হোসেন খান। আরেকটি জিডি করেছেন মেহেদির চাচা মাহাবুব তালুকদার।
জিডি দুটির তদন্ত কর্মকর্তা বনানী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সোহেল রানা গতকাল বলেন, সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার (১ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় বনানী কাঁচাবাজার এলাকার নর্দান ক্যাফে রেস্তোরাঁয় চার তরুণকে একত্রে দেখা গিয়েছিল। এরপর থেকেই তাঁরা নিখোঁজ। ওই এলাকা থেকেই একই সময়ে তাঁদের মুঠোফোনগুলো বন্ধ হয়ে যায়। তাঁদের খোঁজাখুঁজি চলছে।
এর আগে গত বছরের ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত কয়েক দফায় ঢাকার বেশ কয়েকজন তরুণ নিখোঁজ হয়েছিলেন। ১ জুলাই গুলশানে জঙ্গি হামলার পর জানা গেল, ওই সব তরুণ জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঘর ছেড়েছিলেন। পরে জঙ্গি হামলায় অংশ নিয়ে বা পুলিশ-র্যাবের বিভিন্ন অভিযানে অনেকে নিহত হয়েছেন। গত কয়েক মাস জঙ্গি তৎপরতা অনেকটাই স্তিমিত। পুলিশ বলছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। এরই মধ্যে আবার একসঙ্গে চার তরুণ নিখোঁজের ঘটনা সংশ্লিষ্ট সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে।
তবে জাইন হোসেনের বাবা ইসমাইল হোসেন খান গতকাল বলেন, ‘জাইন তো নামাজ পড়ে না। শুক্রবার আমি জোর করে মসজিদে জুমার নামাজের জন্য পাঠাতাম। তা ছাড়া ও কখনো বাসার বাইরে গিয়ে কোথাও দুই রাতের বেশি থাকতে পারে না। ও খুবই খুঁতখুঁতে, খাবারদাবারের বিষয়েও শুচিবাই রয়েছে। এ অবস্থায় সে স্বেচ্ছায় কোথাও চলে যাবে তা মনে হয় না।’
ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন জানান, জাইন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বাসা থেকে বের হন। সাড়ে আটটার মধ্যে বাসায় ফিরে বোনকে নিয়ে পড়াতে বসার কথা ছিল। ফিরতে দেরি দেখে কল করে তাঁর মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তিনি বলেন, তাঁর ছেলে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র। শেষ সেমিস্টারের ফাইনাল পরীক্ষা দিচ্ছিলেন, পরীক্ষা এখনো শেষ হয়নি। নিখোঁজ সাফায়াতও একই বিশ্ববিদ্যালয়ে জাইনের সহপাঠী। সুজনও তাঁর বন্ধু। তবে মেহেদিকে তিনি চেনেন না।
নিখোঁজ সুজনের ভাই মো. সুমন বলেন, তাঁদের বাড়ি বরিশালের বাবুগঞ্জে। ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বনানীর একটি বাসায় কাজ করেছেন সুজন। পরে বাসার মালিকদের সঙ্গে একটা আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়। বাসার মালিকদের আর্থিক সহায়তায় সুজন ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটারের ওপর একটি কোর্সে পড়াশোনা করেন। পরে ওই মালিকদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগে চাকরি দেওয়া হয় সুজনকে।
জানা গেছে, সুজন যে বাড়িতে কাজ করতেন, সেই একই ভবনের আরেকটি ফ্ল্যাটের মালিকের ছেলে জাইন। একই ভবনে থাকার সুবাদে দুজনের বন্ধুত্ব হয়। আর জাইনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলেন সাফায়াত। অপরজন মেহেদি হলেন সুজনের গ্রামের বন্ধু। বরিশালে একই গ্রামে পাশাপাশি বাড়ি তাঁদের।
মেহেদির চাচা মাহাবুব হাওলাদার বলেন, বরিশালের বিএম কলেজ থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তরে পড়ছিলেন মেহেদি। গত ২৬ নভেম্বর একটি
বহুজাতিক কোম্পানিতে নিয়োগ পরীক্ষা দিতে তিনি ঢাকায় আসেন। ওঠেন রায়েরবাজারে ফুফুর বাড়িতে। নিয়োগ পরীক্ষা শেষে বৃহস্পতিবার ল্যাপটপে কিছু সফটওয়্যার আপডেটের জন্য সুজনের কাছে নিয়ে যান মেহেদি। এরপর থেকেই তাঁকে পাওয়া যাচ্ছে না।
অভিভাবকেরা জানান, এই চার তরুণের মধ্যে সাফায়াত ধর্মের প্রতি অনুরাগী ছিলেন। নিয়মিত নামাজ পড়তেন। তাঁর ফেসবুক প্রোফাইল ঘেঁটে দেখা গেছে, তিনি বেশ কয়েকজন বিতর্কিত ইসলামি চিন্তাবিদের ধর্মবিষয়ক মতামত তুলে ধরেছেন। গত মাস পর্যন্ত এ চারজনই ফেসবুকে সক্রিয় ছিলেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, এই চার তরুণের বয়স, সামাজিক অবস্থান, লেখাপড়া এবং নিখোঁজ হওয়ার ধরনের সঙ্গে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলাকারী নিবরাস ইসলাম, রোহান ইমতিয়াজ, মোবাশ্বির এবং কল্যাণপুর ও গাজীপুরে পুলিশের অভিযানে নিহত তরুণদের ঘর ছাড়ার সঙ্গে মিল আছে। তাই ঘটনাটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহি চৌধুরী বলেন, এর একটা বিশদ তদন্ত হওয়া উচিত। এই ছেলেরা কোথায় যেতেন, কার সঙ্গে মিশতেন ইত্যাদি বিষয়ে সব তথ্য নিতে হবে। তিনি বলেন, অনেক সময় সন্তানদের বিষয়ে পরিবারও অনেক তথ্য জানে না। মা-বাবা খোঁজ রাখেন না। সন্তানেরা কোথায় যায়, কার সঙ্গে মেশে, তাদের আচরণে হঠাৎ কোনো পরিবর্তন এল কি না—এগুলোও আমাদের ভাবতে হবে।